ইচ্ছে-ঘুড়ির বাউল ~ শাখা নির্ভানা


ইচ্ছে-ঘুড়ির বাউল
শাখা নির্ভানা

১ম পর্ব

বহুদিন পরে একবার আমার সেই প্রিয় নদীর প্রিয় বালুচরের বায়ু সেবনের ইচ্ছা হলো। গেলাম সেখানে। পরনে রিপড জিনস, পায়ে জর্ডন স্নিকার। এই বেশে এখানে কেন! নিজের চরিত্র দোষে হয়তোবা। সবাই কেমন দূরে দূরে। আমি কি সবার পর হয়ে গেছি এই দেশে, এই বেশে! হঠাৎ করে বালুচরের সেই পুরানো নেড়ে বটগাছের তলায় কেনা গায়েনের সাক্ষাত। সেই শতচ্ছিন্ন কেনা বাউল। আমাকে দেখেই গান থামিয়ে পরম স্নেহে কাছে ডেকে বললো- সেখের পো, হাল কি? একখান সিগারেট দেও দিনি, তোমাগো সায়েবী সিগারেট।

গায়েনের কথা বলার ঢং দেখে মন ভিজে গেল। বসে পড়লাম পাশে। আমার আর তার বয়স যেন এক হয়ে গেল। যেন বহু দিনের পুরানো বন্ধু আমরা। পাঁচশ পঞ্চান্নর পুরা প্যাকেটটা তাকে দিয়ে বললাম- নেও তুমারে দিলাম।
-আমি কি তুমার কাছে পুরো প্যাকেট চাইছি?
একটা নিলো, পুরাটা নিলো না। আমার প্রবাস-গর্ব একটুখানি খাটো হলো বা। মনে পড়ে গেলো, সেই শিশুকালে হাটবারে ঠিক এই অশীতিপর বটগাছের নীচে বসে তার গান শুনতাম থুতনির নীচে হাত রেখে ছদ্ম-মনোযোগে। গান শেষ, শিশু আমি বসে আছি ঠিক সেই ভাবে। কাছে এসে কেনা গায়েন আমার অস্তিত্বটাকে চমকে দিয়ে বলতো- কিগো সেখের পো আরও গান শুনবা? একটা বড় বীচিকলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো- এইডে নিয়ে বাড়ী যাও, সন্ধ্যে হয়ে গেছে।

সেই বহুপুরোনো আমার মন-স্বজন যুবক বাউল আজকে বৃদ্ধ, বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ। সংসার হয়নি, করে নি। কারো কাছে কিছু চায় না। দশটা দিলে নয়টা ফেরত দিয়ে দেয়। চাহিদা নেই, উচ্চাশা নেই- একবিংশ শতকের এক বিস্ময় মানব।

হঠাৎ করে চমকে তার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললাম- গায়েন তুমার সেই চুল-দাড়ি কই?
কোন উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে রইলো, যেন মন-সাঁইজির ধ্যানে। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো তার। উত্তরের জন্যে আবার একটা তাগাদা দিলাম। হাত-শরীর কেঁপে উঠলো, রাগে না অভিমানে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
-আগের জম্মে পাপ ছেলো, তারই খ্যাশারত দিতি হলো সেখের পো, খ্যাশারত। নিজির শরীরডাই যেন অন্য কারুর হয়ে গেছে- ডরাই, বিস্তর ডরাই এহন। আমি যাই, বেলা গেল।

কেনা গায়েনের বেলা যায়। তার গমন পথে ধুসর পৃথিবীর ছায়া পড়ে। আমি বসে থাকি বৃদ্ধবটমূলে। মুখে হাত দিয়ে বসে ভাবি, শেষে এই নিঃস্ব কেনাকেও খেসারত দিতে হলো, ধর্মীয় বিচ্যুতির খেসারত? কী না পারে এই ধর্ম!

২য় পর্ব

নদীর বালুচরে সারি সারি নৌকা। কোনটা উপুড় করা, কোনটা চিত করা, কোনটা বা কাত করা। সুতোররা কাজ করছে একমনে- কেউ করাত চালাচ্ছে, কেউ শিরিশ মারছে, কেউ বা আলকাতরা লাগাচ্ছে তক্তায়। আলকাতরার গন্ধে ময়ময় চারদিক। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের একপাশে চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছে গায়েন, কেনা গায়েন। মাথা ভরা তার সাদা খোঁচা খোঁচা চুল, মুখে ধবধবে সাদা খাটো দাড়ি, খালি পা, শতচ্ছিন্ন অমলিন পিরহানের ভিতর দিয়ে কৃশ শরীরটা দেখা যায়। হাতে ধরা তার একটা দোতারা। কেনা গায়েনের মতন আরেক মলিন অস্তিত্ব এই আমার গাঁ। এই গাঁয়ের কাদা-মাটি-বালুর সাথে যে সুতোয় বাঁধা আছে কেনা গায়েনের নাম, ঠিক সেই বিনীসুতোর বাঁধনও আমাকে কিভাবে জানি টেনে নিয়ে হাজির করে সেই গাঁয়ের বালুচরে প্রতিবার। প্রতিবারই দেশে এসে সেই টানে ছুটে আসি আমার প্রিয় বালুচরে।
আকাশে মেঘ ছিল, কিন্তু বৃষ্টি ছিল না সেদিন। ঠাণ্ডা ছায়ার ভিতর দিয়ে হাটতে হাটতে শেষে বসে পড়লাম গায়েনের পাশে, বুনো গাছের শিকড়ের আসনে। গান থেমে গেল।
-থামলে কেন গায়েন? ভালই তো গাচ্ছিলে। গাও না।
শুকনো মুখে পরিচিত সলজ্জ হাসি গায়েনের। আবার শুরু হলো গান।

আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যেরে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
বেড়াই ঘুরে। আমি কোথায় পাবো……

একটার পর একটা গেয়ে চলেছে গায়েন। ক্লান্তিহীন শরীরে একখানা মলিন মুখ তবু এক টুকরো হাসি ধরে রেখেছে প্রাণপণে। নিজেকে কিঞ্চিত অপরাধী মনে হলো। দুপুর গড়িয়ে গেছে, আহারে বেচারার হয়তো সকাল থেকে কিছু খাওয়াই হয়নি। এতটা সময় ধরে কি সুধাই না ঢাললো সে সবার কানে। নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধাওয়া বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশ চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
-খাওয়া দাওয়া কিছু হইছে?
-ওই সুতোররা মনে হলে কখনও দেয়, না হলে দেয় না। এভাবেই চলে, চইলবে। উপরঅলা এক সময় জুটায় দেয়।
গায়েনের কথা শুনে আমার বাউল গানের মুগ্ধতা অনেকটা আত্মধিক্কারে রূপ নিলো।
পকেট থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- এই টাকাটা তুমি রাখো। তোমার অসুবিধের সময় কাজে লাগবে।
দেহে ছোট্ট একটা কাঁপন উঠলো তার। মুখের রঙ গেল পালটে। ভাবলাম, হয়তো অপমান বোধ করেছে। বাউল গানে অভ্যস্ত ঠোটজোড়া কেঁপে উঠলো যেন।
-সেখের পো, এতবড় টাকা আমার বাপের জনমে আমি হাতে করিনি। করতিও চাইনে আর। আমার ওই পেটের জন্যি দুটো দানার জোগাড় হলেই খুশি। যেহানে রাইত, সেহানেই কাইত। আমার টাকা লাগবে না।
মোটা চালের ভাত আর ডাল এলো গায়েনের জন্যে। টাকাটা নিলো না গায়েন। দেখলাম, তখনও তার মুখে লেগে রয়েছে সেই সন্তুষ্টির টুকরো হাসিটা। বসে বসে খাওয়াটা দেখলাম তার। খাওয়ার পর আবার গান ধরলো গায়েন।

মহাভাবের মানুষ যে জনা
দেখলে যায়রে চেনা।
ও তার আঁখি দুটি ছলছল,
মুখে মৃদুহাসির পতন হয় না
দেখলে যায়রে চেনা……
ও তার কামনদীতে চর পড়েছে,
প্রেম নদীতে জল ধরে না।
দেখলে যায়রে চেনা………

তন্ময় হয়ে শুনছি আর ভাবছি- সে কি মহাভাবের মানুষ, আমি কি একজন ভাবের মানুষের সামনে বসে আছি? নির্ভেজাল ভাব দিয়ে কি জীবন চলে?
হঠাত চমকে দিয়ে গান থেমে গেল গায়েনের।
-তোমার হাতে তো সময় আছে, চলো না ওই চরের ওপারে এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
রাজী হয়ে বললাম- চলো।
গায়েনের সাথে হাটতে হাটতে চলে এলাম চরের ওপারে। একটা ছাপড়া ঘর, সেই ঘরে সে কাশি দিয়ে ঢুকে পড়লো আমাকে নিয়ে। আমার হয়তো অবাক হওয়ার আরও বাকী ছিল। দেখলাম- এক অশীতিপর বৃদ্ধ ঘরের মেঝেয় বসে তার বৃদ্ধার পায়ে ওষুধ লাগাচ্ছে, সারা পায়ে যার দগদগে বিষাক্ত ঘা।
আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে গায়েন বুড়োর হাতে গুজে দিয়ে বললো- যাই বাবা, যাই মা। আবার আসবোনে সময় হলি।
চোখ ছাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়া পানি সে সতর্ক হাতে লুকালো যেন।
তড়িঘড়ি করে ঘরের বাইরে এসে গায়েন আমর হাত চেপে ধরে বললো- সেখের পো, তুমার কাছে আমি বড় ঋণী হয়ে রইলাম গো, চিরঋণী। অরা আমার কেউ না, ওগের কষ্টে আমার বুক ভাঙ্গে। তবু তুমার কথাই ঠিক- শুধু ভাব দিয়ে কি জীবন চলে? চলে না সেখের পো, চলে না। তুমি সুরের পাগল। যাই, আমার দিন ফুরায়। আবার কোন দিন দেখা হবিনে, কোন সুরের হাটে।
আমায় কিছু বলতে না দিয়ে চলে গেল গায়েন। আমিও চলতে থাকি আমার পথে। চলতে চলতে ভাবছি, আমার মনের কথা তার কাছে পৌঁছল কেমনে? সাধারণ মানুষের অসাধারণ আবেগ দেখে অবাক হলাম, হলাম হতবাক। কেনা গায়েন সাধারণের বেশে মহাভাবের মানুষ। সে অন্তর্যামীও। মানুষের মনের গহনে লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো আলোতে বেরিয়ে আনার দক্ষতাও আছে তার। ভাবলাম, বুঝলাম- সে নতুন যুগের নতুন বাউল, ঠিক আগের মতন না। শুধু ভাবে তার জীবন চলে না। চলা উচিতও না। রবিঠাকুরের ডাকঘর গল্পের ছোট রুগ্ন ছেলেটার সাধ হয়েছিল দইওয়ালা হবার। ইচ্ছে করেছিল দৈ রাখবেন দৈ, ভাল দৈ আছেবলে হাঁক ছেড়ে ছেড়ে পাহাড়ের রাস্তা ধরে হারিয়ে যাবার। বাউলকে দেখে আমারও ইচ্ছা জেগেছে মনে, হাতে দোতারা নিয়ে গান গেতে গেতে নদীর গা ঘেঁষে ছোট্ট চেনা রাস্তা ধরে হারিয়ে যাব একদিন। আঙ্গুলে থাকবে সুরেলা তার, আর মুখে থাকবে কোন অচেনা কবির প্রিয় সুর।

মন তোর সন্ধ্যে হলো
দিন ফুরল ভেবে দেখলি নে।
তোর হাতে পায়ে দেখলি বান্ধন,
খোলা মন তো দেখলি নে।

শাখা নির্ভানা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন