শিল্প সাহিত্যে বিভিন্ন মতবাদের ক্রমবিকাশ : প্রসঙ্গে জিরো বাউন্ডারি কবিতা ~ নাসির ওয়াদেন


শিল্প সাহিত্যে বিভিন্ন মতবাদের ক্রমবিকাশ :
প্রসঙ্গে জিরো বাউন্ডারি কবিতা
নাসির ওয়াদেন

      শিল্প সাহিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি অঙ্কনের অন্যতম মাধ্যম। জীবনকে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে, বুঝতে শিল্পের মাধ্যমের কিংবা সাহিত্য রচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে শব্দের ধ্বনিগত পরিবর্তন যেমন ঘটে,তেমন শব্দের অর্থেও পরিবর্তন দেখা যায়। বিভিন্ন কারণে এই পরিবর্তন হওয়া এটা যেমন সত্য, তেমনি স্থান, কাল, পাত্র ভেদে, ভৌগোলিক কিংবা ঐতিহাসিক কারণেও পরিবর্তন ঘটে, আবার মনের নিভৃতে বিশ্বাস, আরামপ্রিয়তা, আলংকারিক প্রয়োগের মাধ্যমেও পরিবর্তন হতে পারে ।
        ভাষা নদীর মতো প্রবাহমান,চিরকালিন, শ্বাশত ও চিরন্তনী। বাংলা ভাষার উৎপত্তি নবম-দশম শতাব্দী অর্থাৎ আনুমানিক ১৩৫০ পর্যন্ত সময়কে প্রাচীন বাংলা সময়কাল ধরা হয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মধ্য বাংলা ভাষার আগমন । নানান বাক্ ও ঘাতে পরিবর্তন ঘটে।ইতিমধ্যে নানান বিদেশী ভাষার শব্দ, শব্দ-বন্ধ,শ্লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ।ফলে নতুন নতুন গতিপথ ধরে ভাষাও আধুনিকতা লাভ করেছে । নানা ভাব,লক্ষণকে কেন্দ্র করে আধুনিক কবিতার উৎপত্তি । বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শিল্প বিপ্লবের উজ্জ্বল শিখা আর ফরাসী বিপ্লবে জনতার বিজয়লাভ, নতুন মোড়ক খুলে দেয়।ভাবের দিক দিয়ে তার উত্তরণ ঘটে, রবীন্দ্র মুক্ত চিন্তন প্রসারিত হয়। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি,ও নৈরাশ্যবোধ, নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত,ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রভাব ও দৈহিক ইন্দ্রিয় সুখভোগ, বিশ্বসাহিত্যের পরোক্ষ প্রভাবে মার্কসীয় দর্শনের বস্তুবাদী চিন্তার প্রসার,অলৌকিক ও ধর্মীয় বিষয়ে অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞান, গতানুগতিকতা আর মূল্যবোধের প্রতি অবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে পড়ে । প্রচলিত রীতিনীতি, ছন্দ, উপকরণ নির্ভরশীলতার উর্ধ্বে গদ্য ছন্দ ও মুক্ত গদ্যের আবির্ভাব ঘটে । বিষয় বৈচিত্র্যের সাথে বিষয়ান্তরে যাওয়ার পথে শূন্যতা বা ব্যবধান পাঠককে আকৃষ্ট করে তোলে। শিল্প সাহিত্যে নবজাগরণের ছোঁয়া লেগে নতুনত্বের প্রাপ্তিযোগ ঘটে।
        নদীর স্রোতের মতো সময় তো থেমে থাকবে না ।ঘড়ি টিক টিক শব্দ করে যেমন ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, তেমনি ভাষাও ক্রমে ক্রমে রূপ ও আত্মার পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে --আধুনিকতার ছোঁয়া মেখে যে শিল্প সাহিত্য, কবিতা গতি প্রাপ্ত হয়েছিল, সেই গতিতে নতুন রঙের আবির্ভাব ঘটল। উঠে এলো আন্দোলনের নানা রূপ, আন্দোলনের নতুন নতুন আলোচনা, বিভিন্ন মত ও মতান্তর । শিল্প সাহিত্যের --পরীক্ষা --নিরীক্ষা জীবনে নতুন চেতনার দ্বারা বিশ্লেষণ করার সুতীব্র মানসিকতা ও অভিব্যক্তি। গড়ে উঠল মতবাদ, আন্দোলন ও নতুন যাত্রাপথ। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতবাদের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজনে কিছু বলা দরকার, অভিব্যক্তিবাদ যা সাহিত্য বা শিল্পকলা ও চিত্রকলার বাহ্যিক জীবনের থেকে অভ্যন্তরীণ জীবনের মানসিক অভিব্যক্তিবাদ পরিস্ফুটন ঘটে। এই অভিব্যক্তির বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ ঘটে। উঠে আসে অস্তিবাদের কথা। অস্তিবাদ বা অস্তিত্ববাদ তত্ত্বে মানবদেহ, রক্ত মাংস আর তার অস্তিত্ব নিয়ে বিবিধ চিন্তা ভাবনা । জগতের সম্পর্কের সাথে মানুষের সম্পর্কেই অস্তিত্বের বাস্তবতা নিয়ে সন্ধানের ভেতর দিয়ে সামাজিক ও আত্মিক শূন্যতার ছবিকে লেখনী ভাষায় বা ঈজলে পরিস্ফুট করা । অনেক পথ এগিয়ে এসেছে, পুরাতন বিসর্জন দিয়ে নতুনত্বের পরমাদ পেয়েছি, এগিয়ে চলেছি নতুন নতুন চিন্তার খোরাক নিয়ে। দেখতে পাই একদল দার্শনিকের নতুন ভাবনা, ইন্দ্রজাল বাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম। সম্ভবত কিউবার উপন্যাসিক Alejo Carpentier এর মতানুসারে--" What is the story of Latin America if not a chronicle of the marvellous in the real? " -- বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব জগৎ নির্ভর ন্যারেটিভের ভেতরে অবিচার্য ও অধিবাস্তব ঘটনার আশ্চর্য উপস্থিতি, অর্থাৎ ঐন্দ্রজালিক উপস্থাপনা। মার্কিন সমালোচক  Alastair Reid " ম্যাজিক রিয়ালিজম " শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনার পাশাপাশি উদ্ভট কল্পনা ও খেয়ালিপনার কল্পলোকে চলে যাওয়া। সাহিত্যের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যকে নতুনভাবে ধরতে চাওয়া। এভাবেই শিল্পকলার ভেতরে ইমপ্রেশনিজম বা ভাবপ্রবনতার বিস্তার ঘটতে থাকে।এক্ষেত্রে রঙ ও আলোর ব্যবহারে শিল্পের গরিমা বৃদ্ধি ঘটে। গাণিতিক ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুকে রঙের সমারোহে উজ্জ্বলতম ভাবে প্রদীপ্ত করতে আঁচড়ে পরিণত করার ভেতর Pointillism গড়ে ওঠে ।এই ভাবনা সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার না করলেও শিল্পে বাহুল্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ।
        উদ্ভট তত্ত্ব যাকে Movement of the Absurd বলে চিহ্নিত করেছেন কেউ কেউ; অ্যালবেয়ার ক্যামুর অস্তিবাদী চিন্তা থেকেই। সামাজিক, রাজনৈতিক বিপর্যয় যখন মানুষকে হতাশ, বেদনা ক্লিষ্ট ও বিষন্ন করে তোলে, তখনই, যুক্তির পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৌলতে ও যান্ত্রিকতার উন্নতি হলেও, আভ্যন্তরীণ প্রশ্নে সংকট নেমে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর কালোছায়া, দার্শনিকদের মনে প্রভাব ফেলে নৈরাশ্যের উদ্ভট ভাবনার। জীবন অশিক্ষিত,অর্থহীন হয়ে পড়ে ।ঈশ্বর বেঁচে নেই, সবই সম্ভব। এই ধারণার বিস্তার ঘটাতে হবে ।
        বিশ্বশান্তি, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠার ফলে মানুষের জীবনে শান্তির বার্তা আনে,ফ্যাসিবাদের পরাজয়ে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব সুখ সমৃদ্ধির ছায়াতলে কল্পনা বিলাসী হতে থাকে । প্রকৃতি ও নিসর্গ প্রীতি থেকে রোমান্টিক কাব্য রচনার প্রেরণা পায়। নিবিড় অনুরাগ ও মমত্ববোধ থেকে প্রকৃতির অন্তর্লীন আনন্দ ও প্রশান্তির স্বরূপ উদ্ঘাটিত হতে থাকে। কাব্যের ছন্দে, শব্দে প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে যায়,সৌন্দর্যের পূজারী কিটস্, প্রকৃতি প্রেমিক ওয়ার্ডওয়ার্থ, জেমস টমসন প্রভৃতি কবিদের কলমে ।
        চিত্রকল্পবাদও আধুনিক কবিতায় আধুনিকতাবাদীদের আন্দোলনের 'ইমেজিষ্ট' কবিদের চিত্রকল্প ও আঙ্গিকের উপস্থাপনা দেখা যায়। ১৯১৩ সালে মার্কিন পত্রিকা' Poetry' তে 'ইভেজিষ্ট' গোষ্ঠীর এজরা পাউন্ড রচনার বিষয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সম্পাদনা করে একটি কবিতার সংকলন । এতে দেখা যায়, মুখ প্রসবিত শব্দের ব্যবহার, গম্ভীর ও অলংকারময় শব্দের বর্জন করা ,চিত্রকল্পের নিবিড় রূপদানের ভেতর বিষয় নির্বাচনে কবিকে স্বাধীনতা, গদ্য ছন্দের ব্যবহার করে অন্তমিল পরিহার করা, কবিতার ভাষা স্পষ্টতর ,দৃঢ়তা সম্পৃক্ত হওয়া ইত্যাদি ।
         এসেছে ডাডাবাদ, যার অর্থ কাঠের ঘোড়া ।এই মতবাদের সূচনাতে দেখা যায় যে, একদল কবি ও শিল্পী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা ও বিনাশের মধ্য থেকে কীভাবে প্রচলিত রীতি, প্রথা, বক্তব্য, ভাষাকে ছিন্নভিন্ন করে নতুন পথে চালিত করতে চেয়েছিল ।স্বাভাবিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে শিল্প সাহিত্যের নামে যে ধাপ্পাবাজি চলছে, চালাকি আছে, তাকে পরিহার করে ,কবিতায় অসংলগ্নতা,দুর্বোধ্যতা, শব্দের যথেচ্ছাচার ব্যবহার ঘটানো,যা অস্থায়ী হয়ে যায় ।অবশ্য ডাডাবাদের পরবর্তীতে ফল হিসেবে অধিবাস্তববাদ বা স্যুররিয়ালিজম্ মতবাদ উঠে আসে। ১৯১৭ সালে কবি গীয়স আপালোনিয়ার "surrealism ' শব্দটি ব্যবহার করেন। ফ্রয়েডের স্বপ্ন-তত্ব ছিল "পরাবাস্তবতা"র মূলাধার। স্বপ্নে যেমন অর্ধচেতন ও অবচেতনের জগত এলোমেলো চিত্র --কল্পনায় ধরা পড়ে, তেমনি কবিতা বা ছবিও প্রকৃত বাস্তবকে প্রকাশ করতে চায়, চেতনা, যুক্তি পারম্পর্য নিরপেক্ষ ভাবে। তাদের মতে যে জাগ্রত ও সচেতন চিন্তা যখন শিথিল হয়,তখনই মগ্ন চৈতন্য থেকে মনের বাহনের চিন্তাকে যা আদিম, অবাধ অকৃত্রিম সেই স্বপ্নালোককে রূপায়িত করতে প্রয়াসী হয়। প্রতীকের মাধ্যমে মগ্ন চৈতন্যকে প্রতিফলিত করাই মূল লক্ষ্য। যুক্তির চেয়ে আবেগই হলো প্রতীক ও চিত্রকল্পের নিবিড় যোগসূত্র। প্রতীক ও চিত্রকল্প ভাবনা থেকে প্রতীকবাদ উঠে আসে।জড়বাদী বিজ্ঞান ও বাস্তববাদী সাহিত্যাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই এই' সিম্বোলিস্ট' কবিগোষ্ঠী প্রতীক ও অভিভারের মাধ্যমে জগতের আপাতগ্রাহ্যতার বাইরে যে ভাবালোক আছে, তাকে আভাসিত করা। এইভাবে কবিতা তথা সৃজনী সাহিত্যে নতুন আঙ্গিক ও আদর্শ উপনীত হতে থাকে। ভাব দিয়ে কবিতা হয় না, লেখা হয় শব্দ দিয়ে, আর শব্দের আদিতে আছে সংগীত বা তীব্রতা,তাই তো শব্দই ব্রহ্ম।
           সমকালীন জীবনের বাস্তবতা যথাযথ বিশ্বাস সন্নিবিষ্ট, 'ডকুমেন্টেশন'বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ ও তন্ময় চিত্রণের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবন সমস্যার বিশ্লেষণ, সমাজের সকলস্তরের মানুষের কথার ব্যবহার, মুক্ত গদ্যের প্রভাব বিস্তার ঘটিয়ে বিজ্ঞানের আলোকে মানুষের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার ও প্রত্যক্ষ জীবনকেই চরম সত্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। সেই থেকে বাস্তববাদের উৎপত্তি।মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাসমূহের বাস্তবতাকে গভীর আগ্রহে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলে ধরাই 'রিয়ালিষ্ট'দের কাজ। 'মিস্টিসিজম'ও রোমান্টিকতার সমগোত্রী। নিছক, যুক্তি বুদ্ধি, মনন বিশ্লেষণে জগত ও জীবনকে না ধরে মনের গভীরে অনুভূতির অতলে,ইন্দ্রিয় নির্ভর রূপলোকের অরূপ সত্তার অনুধাবন করা।এসেছে যথাস্থিতবাদ বা ন্যাচারিলজম' যা প্রকৃতিবাদ নামেও চিহ্নিত ।অর্থাৎ বাস্তববাদের চরম রূপই যথাস্থিতবাদ ।
        ১৯৩৪ এ সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার তত্ত্বকে শিল্পে, সাহিত্যে,সংস্কৃতিতে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে মেলে ধরা ।মার্কসীয় নন্দনতত্বে অর্থনৈতিক ভিত্তি 'কে কেন্দ্র করে বাস্তবতা থেকেই জন্ম নেয় -শিল্প, সাহিত্য, "শিল্পের জন্য শিল্প নয়" -এধরনের ভাবনার বিরুদ্ধচারণ করে শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার, শ্রেণি চেতনার আলোকে বাস্তবতার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা বা socialist Realismএর আবির্ভাব ।"সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা "কথাটি ১৯৩৪ সালে মে মাসে "প্রাভদা"য় প্রকাশিত হলেও ভাবনাটা পূর্ব থেকে জারিত হয়ে আসছে।
        সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারণা ও ভাবনাকে কেন্দ্র করেই মতবাদের উৎপত্তি হয়ে আসছে। আধুনিককালের পরবর্তীতে উত্তর আধুনিকতাবাদের কথাও উঠে আসে। আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করে দেখেছি সেখানে নতুন নতুন ভাবনা চিন্তার বিস্তার ঘটেছে, বিষয় বৈচিত্রের সাথে বিষয়স্তরে শূন্যতা থাকছে--
           উত্তর আধুনিকতাবাদ কিন্তু আধুনিকতাবাদের বিরোধী একটি দার্শনিক আন্দোলনের নাম ।উত্তর আধুনিকতার সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা না গেলেও কতকগুলি চারিত্রিক লক্ষণ দেখে প্রভেদকরণ করা যেতে পারে । এই মতবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অনাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গী । '' কোন কিছুকে ধ্রুব বা আদর্শ জেনে বা শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করার জন্য নয়, এবং বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট প্রকরণ ও কাঠামোকে আশ্রয় করে শিল্প সৃষ্টির অভিলাষই আধুনিকতার পরম বৈশিষ্ট্য ।"
            উত্তর আধুনিকতার চরিত্র হলো -ডাডাজিমকে প্রাধান্য দেওয়া, লেখার ক্ষেত্রে উন্মুক্তি, ক্রীড়াময়তা, নৈরাজ্য, নীরবতার সংমিশ্রণ ঘটানো। সৃষ্টির অনির্বাণ বা বিনির্মাণ ঘটানো,বিরোধভাসকে প্রকট করে তোলা ও উপস্থাপনায় সরাসরি অংশগ্রহন করা। নির্দিষ্ট কোনো সীমানা থাকবে না, নির্দিষ্ট কাঠামোর আবদ্ধতা, অর্থময়তা, উদ্দেশ্য নির্ভরতা, নির্মাণের দায়,সমৃদ্ধির দাবী,যুক্তির শাসন, সমন্বয় প্রভৃতি থেকে সফল ভাবে মুক্ত করার।
            কালখণ্ডের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে নতুন নতুন চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটে চলেছে প্রতি মুহূর্তে, সেই মুহূর্তের মধ্য থেকে নতুন নতুন ভাবনার দ্যোতনায় সমৃদ্ধ হতে, জিরো বাউন্ডারি ধারণার কথা এসেছে। আধুনিক চিন্তা চেতনার ক্রম প্রসারণের ভেতর দিয়ে জিবাক একটি নতুন ধরণের উন্মোচন ঘটাতে চায়। জিবাকের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, পূর্বতম মতবাদসমূহের সাথে জিবাক সম্পূর্ণ ভাবে শ্রদ্ধাশীল। কোনো মতবাদকে পরিহার করতে কিংবা পরিবর্তন করতে বলে না, নতুন করে ভাবতে উৎসাহ দেয়। পূর্বতম মতবাদের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা ও কবিতা, শিল্পের ক্ষেত্রে কীভাবে উন্মুক্তি ঘটানো যায় তার ব্যাখ্যা করতে পারে।
              এই সময়েও লক্ষ করা যায় যে, পৃথিবীতে ঔপনিবেশিকতার কাঠামোগত অবসান হলেও মানুষের জীবনে অর্থনীতি,সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য বিরাজ আছে । ফলে মানুষ মুক্তির সোপানে পা রেখে চলতে আগ্রহী।তথাপি এরই মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ তথা সমাজ ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে যে সব বৈষম্য বিরাজ করছে, পৃথকীকরণ ও অপরায়নের মাধ্যমে কালোর উপর সাদা, প্রাচ্যের ওপরে পাশ্চাত্যের উন্নততর সংস্কৃতির আগ্রাসনকে বজায় রাখার সূক্ষ্ম চক্রান্ত চলছে এর সাথে। এ রকম বিবিধ সূত্রের যাঁতাকলে পড়ে মানুষ মুক্তি চাইছে।
           এভাবেই সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্যের মধ্যেও মুক্তির নিঃশ্বাস ঝরে পড়ছে অহরহ কাজকর্মের মধ্যে । সাহিত্যের মধ্যে ঘটছে মুক্তির জন্য, মানবতার জন্য অঘোষিত বিপ্লব, যে বিপ্লব ধ্বনি সমূহের ভেতর নিত্য নতুন ছন্দে উচ্চারিত হয়ে জীবনকে অন্যপথে চালিত করতে প্রেরণা জোগাচ্ছে। কবিতার ভেতরে বিজ্ঞান সময় চেতনার সাথে নিউটনের গতিসূত্রের সহাবস্থানকে আজকের কবিতার মধ্যে নিরীক্ষণ করা সহজ হয়ে পড়ছে। কবি আফজল আলি তাঁর " জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট " এর বিকাশের পথগুলো চিহ্নিত করছেন। কবিতা -অকবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করার কোনো পরিমাপক যন্ত্র না থাকলেও এই ধারণার যে সকল বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখিত করা হয়েছে, তাতে কবিতা ও অকবিতার স্বয়ংক্রিয় ভাবে পৃথকীকরণ ঘটে যায়। কবিতার আঙ্গিকের প্রতিবর্ত প্রক্রিয়ার মতো অনবরত ক্ষয়িষ্ণুতা গ্রাস করে -নতুন অবয়বের,রূপকের,বিমূর্ততা, আত্মগ্লানি, চৈতন্য মুখিনতা,জীবনের অদ্ভূত জলসাঘরে সাগরের উর্মির মতো লহর তোলে। প্রকৃতির সুস্থতা আর ভাবলুতা --চিন্তার মরীচিকা নয়--বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে কবিতার সৌখিন ডানার ঝটপটানি নয়--মগ্ন চৈতন্যের নিগূঢ়তা কবিতার মর্যাদা বৃদ্ধি করে।
         পূর্বের মতবাদের সারবত্তা নিয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশ না করে জিবাক একটি উন্মুক্ত পরিসরের কথা বলতে চেয়েছে। বিশ্বজুড়ে যে বিবাদ তার অবসানও কাম্য। ভাষাসাহিত্যের ক্ষেত্রে যে ছন্দ রয়েছে সেই ছন্দের বন্ধন মুক্তি ঘটানো, যার সারকথা শব্দের ব্যবহার। শব্দকে নতুন ভাষায় নতুন রূপে চিহ্নিত করার ভেতর দিয়ে শব্দের যে জাড্যধর্ম আছে, তাকে ভেঙে যেকোনো দিকে যেকোনো ভাবে ব্যবহার করা।মস্তিষ্ক নির্ভরতার সঙ্গে হৃদয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে পাঠকের মনে আনন্দের উৎসধারা টেনে আনা, কবিতার মধ্যে আরোহণ থাকবে, অবরোহণ থাকবে, ফলে এক কথন থেকে অন্যকথনে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, শব্দকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করা, তাতে শব্দের মধ্যে নিহিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
               জিবাক-এর অন্যতম লক্ষণ উন্মুক্ত পরিসর যেখানে স্রষ্টা শিল্পী কিংবা কবি স্ব-ইচ্ছায় স্বাধীন, তাঁর সৃষ্টি যেকোনো দিকেই বাঁক যেকোনো অবস্থানেই নিতে সক্ষম হবে। ফলে স্রষ্টার ভিতরের শক্তির বহিঃপ্রকাশে ও শৈল্পিক চেতনার মধ্য দিয়ে পূর্বের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত বিষয় যুক্ত বা মুক্ত রেখেই শিল্প বা কবিতার সাধারণ স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণ ঘটানো। বেশি বেশি মানুষকে কবিতার বা শিল্পের process     এর মধ্যে টেনে আনা, inclusion ঘটানো,কোনক্রমেই    elimination করে নয়। সীমানা ভেঙে সর্বস্তরে,বিভাগে তাকে পৌঁছে দেওয়া।কবিতার অঞ্চল উন্মুক্ত, জীবন থেকে শূন্যে, আবার শূন্য থেকে সর্বক্ষেত্রে জ্ঞান সচেতনের সমগ্র শাখায় পৌঁছানো।ফলে কবিতার পরিধি বা গমন অঞ্চল বাড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য  মেধা শক্তির স্ফুরণ ঘটিয়ে চিন্তা, ভাবনার ধারায় মেধার স্ফুরণকে কাজে লাগিয়ে কবিতাকে রূপান্তরকামী শিল্পে উত্তীর্ণ করে তোলা।
            প্রশ্ন আসে, তাহলে কী সব লেখাই কবিতাএর উত্তরে জিবাক যে কথা বলতে চেয়েছে, তা হলো কবিরা ভাষার ইন্জিনিয়ার, তাই কবিদের লেখনীতে এমন ভাষা ব্যবহৃত হবে, যা আগামীতে নতুন চর্চাকে উৎসাহী করে তুলবে, তারই দলিল রূপে কাজ করবে। কবিতার পরিমাপক যন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হবে। জিবাক এর ক্ষেত্রে liberal thinking এর প্রাধান্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে কবি তাঁর সৃজনীর ইচ্ছা স্বাধীনভাবে চালিত করতে পারবেন, কোন পূর্ব আরোপিত শর্ত মেনে চলা বাধ্যবাধক হবে না । কবিতার মধ্যে বর্ণসঙ্করতা বা মিশ্রণীকরণ কিংবা স্যান্ডউইচ সিস্টেম এর ব্যবহার নতুন  কবিতার উৎপত্তি ঘটাতে সক্ষম হবে। প্রচলিত রীতিনীতির উর্ধ্বে অপ্রচলিত রীতি, আঙ্গিক উঠে আসবে। কবিতার মধ্যে যে শব্দ বা শব্দ-বন্ধসমূহের অর্থহীনতার ঝোঁক বিদ্যমান,তার পরিবর্তে অর্থময়তা এবং অর্থময়তার পরিধি বিস্তার লাভ করবে। শব্দের অর্থ বাস্তবধর্মী যেমন হতে পারে, তেমনি কল্পনার পরিমেয় জগতের মধ্যেও নিশ্চিষ্ট হতে সক্ষম।
          আমরা বলতে চাই যে, সার্বিকভাবে শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে   delimitation শব্দটি খুবই প্রযোজ্য। কারণ সমস্ত রকম ঘেরাটোপের বিরুদ্ধে যেতে পারলে, তবেই এক বৃহত্তম গঠন ও তার পরিক্রমা সম্ভব। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এবং শিল্প, সাহিত্য বিশেষ করে কবিতার ধারা থেকে যেটা ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে যে, সমস্ত রকম  boundary'- র বিরুদ্ধে গিয়ে এবং বিলোপের মধ্য দিয়েই সেই বৃহত্তম  structure কে বুঝতে পারা যাবে। যেমন কোনও boundary বা চিন্তার কোনো line of control  থাকে না, মনেরও কোনো line of control  থাকে না,মননে যেকোনো সময় যে কোনো প্রান্তে, যেকোনো ভাব বা ভাবনার রূপ ধরতে সক্ষম।ঠিক সেভাবেই মন নির্গত শিল্প ভাবনার কোনো রকম বাউন্ডারি রেখার বিরুদ্ধে ।সে যেকোনো প্রকল্পের মধ্যে যেভাবে খুশি কাজ করতে পারে এবং শিল্প সাহিত্যের তথা শব্দের ঘেরাটোপের সীমানা গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রকৃত পক্ষ হয়ে ওঠে। তাই কল্পনার রূপ দিতে zero boundary concept হলো এক প্রকার উত্তীর্ণ ও সময়োপযোগী ভাবনা, যার মাধ্যমে আমরা Achieve করতে পারি বিশ্বশান্তি থেকে প্রকৃত শিল্পের সুন্দর ভুবন। কবিতার ক্ষেত্রে তাই জিবাক।
         জিবাক নতুন করে কবিতা আন্দোলনে যুক্ত অভিনবধারা ভাবার কোন অবকাশ নেই। নিত্যদিনের কাব্য রচনার মধ্যে আমরা জিবাক -এর লক্ষণ অনেক কবিতায় দেখতে পাচ্ছি, অতীতের অনেক কবিতার মধ্যে ছায়াপাত ঘটেছে। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে জিবাক নতুন করে ভাবতে, উন্মুক্ত চিন্তনের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছে,মুক্ত ছন্দের দ্বার উন্মোচিত করেছে,যাতে আগামী প্রজন্ম এই বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে কবিতা নির্মাণে সহায়তা পাবে, শুধু তাই নয়, নতুন নতুন আঙ্গিকের যেমন  slice poetry @ ইত্যাদি নতুন ক্ষেত্র বিস্তার করবে,কবিতা আন্দোলনে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে শব্দ গাঁথার মধ্যে কবি তাঁর force apply এর কতটা প্রয়োগ ঘটাতে পারল, আর কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে Advancement এর tendencyকেই কতটা মান্যতা দিতে সক্ষম হচ্ছে, এটাই তার কাজ।কবির অভিজ্ঞতা  প্রতিভা, চিন্তার তীব্রতা ও শব্দের মেলবন্ধন যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে যতটা বিবেচিত হবে, লেখাও সেভাবেই eliminate হয়ে পড়বে automatic    পদ্ধতিতে।
        যাই হোক, কবিতার ক্ষেত্রে জিবাক এক সুন্দরতম, সতেজ, সাবলীল মুক্ত চিন্তার পরিসর উন্মুক্ত করা, ভাবনার উন্মুক্ততা খুলে দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।কালখণ্ডের বিচারে  " জিবাক " নতুন পথপ্রদর্শক হিসেবে এগিয়ে যাবে এই বিশ্বাস ও ভরসা আমার আছে ও থাকবে ।
সার্ত্রের মতো আমারও অভিমত--" I am condemned to be free. "শেষে একটা উদাহরণ দিই : " পতন পর্যন্ত প্রতিটি দাঁড়ি কমাই প্রশ্নবোধক / কোনো কোনো বিজ্ঞান তাই চাপাকলের মতো একা--" ,পাঠক কী কিছু  ভাববেন ••••

নাসির ওয়াদেন


1 টি মন্তব্য:

  1. বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের
    বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বসনা রাখতেন ।
    গাছ নেই নদী নেই অপুস্পক সময় বইছে
    পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই

    শুনুন রবীন্দ্রনাথ, আপনার সমস্ত কবিতা
    আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
    নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
    আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিস্ফলা, ঠাকুর
    আধ্যাত্মিক কবিতা

    উত্তরমুছুন