তৈমুর খান~একটি অপ্রকাশিত কবিতা এবং অকপট স্বীকারোক্তি

মাঝবয়সী মহিলাটি জানতে পারলাম ওর মা। পায়ের চপ্পল খুলে পটাপট দুই গালে মারতে মারতে বললেন, তোর বিবি-বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও আমার মেয়েকে নিয়ে কী খেলা খেললি বল ! তু মাস্টার, তোর কি লজ্জা শরম কিছুই নাই। বেহায়া! হারামজাদা ! ছোটোলোক ! আমি আর থুবড়ি মেয়াটার বিয়ে দিতে পারব?.... অকথ্য গালিগালাজ আর প্রহারের পর জনৈক মাস্টারমশাইকে ছেড়ে দিয়ে ভিড়ের ভেতর মহিলা দুজন কখন অন্তর্হিত হলেন আর দেখতে পেলাম না। এদিকে ছাড়া পেয়ে মাস্টারমশাইও সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাসের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে সরীসৃপের মতো যেতে লাগলেন। আমি কিছুই না বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম। একজন হোমরা-চোমরা গোছের লোক এসে আমার জামার কলারে ধরে দু-ঘুসি বসিয়ে দিলেন আর বললেন, শ্লা, জায়গা পাওনি, বাসস্ট্যান্ডে মেয়েদের সঙ্গে লীলা করতে এসেছ?~~~~~~~~~~~~~~~~~


একটি অপ্রকাশিত কবিতা এবং অকপট স্বীকারোক্তি
তৈমুর খান

জীবনের অনেক কবিতাই থাকে সবগুলো প্রকাশ করা যায় না। সভ্য পৃথিবীর সামাজিক আলোবাতাসে সেসব কবিতা মুখ লুকিয়ে থাকে। এরকমই একটা কবিতা লিখেছিলাম চোখের জলে ভিজে, অপমানের আগুনে পুড়ে। হৃদয় থেকেই তা অনিবার্যভাবে নীরবে উচ্চারিত হয়েছিল। কবিতার ইতিহাসটি এরকম

   ২০০৮ সালের মে মাসের এক সকালবেলা। কর্মস্থল থেকে ফিরছি বাসে চেপে। হঠাৎ বাসের উপরেই দেখা জনৈক এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাইয়ের। মাস্টারমশাই বললেন, আরে চলুন চা খাই, নামুন বাস থেকে।

        আমি ইতস্তত করেও নামলাম। বললাম, চলুন তাড়া আছে, দ্রুত ফিরব।
      মাস্টারমশাই মাথা নাড়লেন।

      বাস থেকে নেমে স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছি, সামনেই চায়ের দোকান। বেঞ্চে বসে চা খাব এটাই উদ্দেশ্য। হঠাৎ পেছন থেকে দুজন মহিলা একজন অষ্টাদশী এবং অন্যজন মাঝবয়সী ছুটে এসে মাস্টারমশাইকে ধরলেন। যুবতীটি তার কানে ও চুলে টেনে ধরে বললেন, তোর শয়তানি সব জানতে পেরেছি, কতদিন লুকিয়ে রাখবি আর ? এবার যাস আমার কাছে, 'ওটা' কেটে তোর হাতে দেব !

    মাঝবয়সী মহিলাটি জানতে পারলাম ওর মা। পায়ের চপ্পল খুলে পটাপট দুই গালে মারতে মারতে বললেন, তোর বিবি-বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও আমার মেয়েকে নিয়ে কী খেলা খেললি বল ! তু মাস্টার, তোর কি লজ্জা শরম কিছুই নাই। বেহায়া! হারামজাদা ! ছোটোলোক ! আমি আর থুবড়ি মেয়াটার বিয়ে দিতে পারব?....

  অকথ্য গালিগালাজ আর প্রহারের পর জনৈক মাস্টারমশাইকে ছেড়ে দিয়ে ভিড়ের ভেতর মহিলা দুজন কখন অন্তর্হিত হলেন আর দেখতে পেলাম না। এদিকে ছাড়া পেয়ে মাস্টারমশাইও সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাসের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে সরীসৃপের মতো যেতে লাগলেন। আমি কিছুই না বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম। একজন হোমরা-চোমরা গোছের লোক এসে আমার জামার কলারে ধরে দু-ঘুসি বসিয়ে দিলেন আর বললেন, শ্লা, জায়গা পাওনি, বাসস্ট্যান্ডে মেয়েদের সঙ্গে লীলা করতে এসেছ?

          আমি চেঁচিয়ে  উঠে বললাম, আমি নই, আমাকে মারবেন না!
          লোকটি মুখ ভেংচে বললে, আমি নই, মারবেন  না! শ্লা আজ সাধু!

           এই বলে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন। তা দেখে আর একজন ইয়্যা বড়ো গোঁফওয়ালা লোক ছুটে এসে আমার হাতদুটো মুচড়ে ধরলেন। বললেন, 'টা মেয়া চাই তোর? কত করতে পারিস?

     এসব বলতে বলতেই দুই হাত দিয়ে আমার প্যান্ট সহ অণ্ডকোষ দুটি পিষে দিতে লাগলেন। অঁ অঁ শব্দে চোখ ফেটে জল এল। প্রতিবাদ করতে পারলাম না। চারিপাশে প্রচুর লোকজন ঘিরে ফেলেছে। আমিও সেই 'দোষী' মাস্টারমশাই তাদের চোখে। সত্য ঘটনাটি বারবার বোঝাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। ততক্ষণে প্রকৃত দোষী মাস্টারমশাইটি বাসের তলা দিয়ে হাইরোডে উঠে গেছেন। আমি তামাশার পাত্র হয়ে এখন নির্যাতন ও মৃত্যুর শমন শুনছি। একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে চেঁচিয়ে বললে, কাপড় খুলে নিয়ে 'ওটা'তে দুটো ইঁট বেঁধে ঝুলিয়ে দাও, বুঝুক ঠ্যালা ! করতে খুব মজা লেগেছিল !

    বাঁচার শেষ চেষ্টায় লাফিয়ে উঠলাম। সেই মুহূর্তেই একটা বাস ছেড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল। বাস থেকে নেমে এলেন আমার এক পরিচিত কন্ডাক্টর। আলগোছে ঝাপটে ধরে চিলের ছোঁ মারার মতো আমাকে তুলে নিলেন বাসে। তারপর গেট বন্ধ করে বললেন, ছাড়ো, জোরে চালাও, কোথাও দাঁড়াবে না !

  বাড়ি ফিরে এসে সে রাতেই যে কবিতাটি লিখেছিলাম তা প্রকাশের জন্য কোথাও পাঠাইনি। সব কবিতা কি প্রকাশ করা যায় ?

  অথচ প্রকাশ করতেই হল যখন অনুমতি পেলাম নিজের কাছেই।
    
               একবার আমার অণ্ডকোষ
               ______________________
একবার আমার অণ্ডকোষ থেঁতলে দিতে
চেয়েছিল কেউ
বিকারগ্রস্ত কেউ, মদ্যপ
জ্বরের তাড়নায় আমাকে দোষী ভেবেছিল

সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম
নির্দোষ হয়েও কেউ কেউ মার খায়
কিছু কিছু ভয়ংকরের সাথে
পথেঘাটে দেখা হয়
তার অন্ধকার বুকের দিকে
তাকাতে পারি না
হিংস্রতার ঘোরে চোখেও বিদ্যুৎ চমকায়
অদৃশ্য থাবার হাতে
পৃথিবীকে লোফালুফি খেলে

তবে খেজুর গাছ হয়ে দাঁড়াই
অণ্ডকোষ কাঁটা হয়ে থাকুক


তৈমুর খান

তৈমুর খান : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট সংলগ্ন পানিসাইল গ্রামে। পিতা মাতা :জিকির খান ও নওরাতুন। শিক্ষা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি। পেশা :উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহশিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থ :কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), নব্বই দশকের কবি ও কবিতা (২০১০), আত্মক্ষরণ (২০১৬), নির্বাচিত কবিতা (২০১৭) ইত্যাদি। পুরস্কার :কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য সম্মান এবং সুখচাঁদ সরকার স্মৃতি পুরস্কার।