সম্পাদকের কলমে ~শতবার্ষিকীর অক্টোবর বিপ্লব ও প্রাসঙ্গিকতা


একটি কথা মানতেই হবে, সকল মানুষের জন্যে সমান অধিকার ও সম সুযোগ, এই ধারণাটি মানুষের প্রত্যয়ে গেঁথে দিতে পেরেছিল মহান অক্টোবর বিপ্লবেরই সুদূরপ্রসারী অভিঘাত। বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই হোক, আজকের মানুষ এই কথাটি বিশ্বাস করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই। সেই অধিকার ও সুযোগ কে কি ভাবে বাস্তবায়িত করবে, বা আদৌ করতে সক্ষম হবে কিনা, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এই ধারণাটির নৈতিকতা নিয়ে আজ আর কেউই কোনভাবেই সন্দিহান নয়। বিগত একশ বছরে এইখানেই অক্টোবর বিপ্লবের প্রাণভোমরা সক্রিয় হয়ে থেকেছে। তাই এই বিপ্লবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলতে চান, বুঝতে হবে জীবনবাস্তবতার সাথে তাদের নাড়ীর যোগ বিলুপ্ত। আবিশ্ব ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির জৌলুসে বিমুগ্ধ হয়ে আজকের দিনে যারা অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতাকেই নস্যাৎ করে দিতে চান, বুঝতে হবে তাদেরও চোখ বন্ধ। বন্ধ বিশ্বায়নের ঠুলিতেই। বিশ্বায়নের এই ঠুলির বিরুদ্ধেই সরব হওয়ার সময় এসেছে আজ।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

শতবার্ষিকীর অক্টোবর বিপ্লব ও প্রাসঙ্গিকতা


৭ই নভেম্বর ১৯১৭! মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিন। লেলিনের হাত ধরে বিশ্বে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিশ্বের ইতিহাসে যা মহান অক্টোবর বিপ্লব নামেই সমধিক পরিচিত। বিশ্বজুড়ে ননান ভাবে পালিত হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক বিপ্লবেরই শতবর্ষ। লেলিনের হাত ধরে ঘটা এই বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই আবিশ্ব পরিচিতি পায় মার্কসবাদ। অমর হয়ে ওঠেন কার্ল মার্কস। এসবই আজ ইতিহাস। অনেকের কাছেই কার্যত মৃত ইতিহাস। বিগত শতকের আশির দশকের শেষে ও নব্বই দশকের শুরুতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও সমাজতন্ত্রের পতন ও আধুনিক যুগের বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদে অনেকেরই বিশ্বাস সমাজতন্ত্র একটি ব্যার্থ প্রয়াস। ফলে আজকের একমেরু বিশ্ব ব্যবস্থায় মহান অক্টোবর বিপ্লবের আর কোনই প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান নয়। হ্যাঁ এইরকমই ভাবেন এযুগের অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু যে কোন সমাজমনস্ক মানুষই বিশেষত যাঁদের চেতনায় বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনের লড়াইয়ের ইতিহাস সম্বন্ধে সামন্যতমও অভিজ্ঞতা আছে; তাঁরা জানেন অক্টোবর বিপ্লবের বিশ্বব্যাপি অভিঘাতের কথা। শুধুমাত্র শ্রমজীবী কৃষিজীবী মানুষই নয়, সাধারণ নাগরিকদেরও জীবনে আধুনিক রাষ্ট্রতন্ত্র কর্তৃক স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলির অধিকাংশই বাস্তবে সংরক্ষিত হয়েছে এই অক্টোবর বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিঘাতের কারণেই। আজকে প্রায় সবরকমের রাষ্ট্রতন্ত্রেই সমাজিক সুরক্ষার বিষয়টির উপর যে নানাভাবে জোর দেওয়া হয়, তার পশ্চাতেই রয়েছে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে উঠে আসা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নাই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে, তার যুগান্তকারি অনেক সুফল।

বস্তুত কার্ল মার্কসের অর্থনৈতিক দর্শন ও লেলিনের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রতন্ত্রের বাস্তবিক প্রয়োগের ভিতর দিয়েই মানুষের চেতনায় অর্থনৈতিক শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ লড়াইয়ের প্রত্যয় ও দিগদর্শন গড়ে ওঠে। সেই বৈপ্লিক চেতনার প্রথম সূত্রপাতই ঘটে মহান অক্টোবর বিপ্লবের হাত ধরেই। যে চেতনা পরে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানান প্রান্তেই। এইখানেই অক্টোবর বিপ্লবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। আজ একমেরু বিশ্বের ধনতান্ত্রিক ভোগবাদের বিজয় রথের দূর্বার গতির সাফল্য দেখে হয়তো অনেকেরই চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছি। আর চোখ ধাঁধিয়ে গেলে যা হয়, স্পষ্ট দেখা যায় না অনেক কিছুই। যতটুকু দেখা যায়, তার বেশির ভাগটাই আবার বস্তুত দৃশ্য বিভ্রম মাত্র। ঠিক সেইটিই ঘটে চলেছে আজকের বৌদ্ধিক মানসে। তাই অনেকেই অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকীর প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই সন্দিহান। আবার অনেকেই আজকের বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদে এতটাই মশগুল যে হাতের কাছে চাহিদা মতো ভোগ্যপণ্যগুলি নিয়মিত পেয়ে গেলেই উর্দ্ধবাহু হয়ে ধনতন্ত্রের জয়গান প্রচার করে চলেছেন। এঁদের কারুর পক্ষেই প্রদীপের তলার আসল অন্ধকারের গভীরতাটুকু তলিয়ে দেখার সামর্থ্য ও অবসর কোনটাই নাই। কিন্তু কথায় বলে অন্ধ হয়ে থাকলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। হবেও না।

মানুষের ইতিহাস বস্তুত অসাম্যের বিরুদ্ধে বঞ্চনার বিরুদ্ধে শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের ইতিহাস। মানুষের সমাজ গড়ে উঠেছে শোষক ও শোষিতকে নিয়েই। এই দুই পক্ষের পারস্পরিক লড়াই ও দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই সমাজ বিবর্তিত হয়ে চলেছে। সমাজ বিবর্তনের সেই নানান ধাপগুলির মধ্যে অক্টোবর বিপ্লব একটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। অনেকেই বলবেন, সব সমাজই একই ভাবে একই সময়ে বিবর্তিত হয় না। আর অক্টোবর বিপ্লব শুধু মাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। খুবই সত্য কথা। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আবিশ্ব প্রায় সকল দেশে ও সমাজেই কোন না কোনভাবে কিছু না কিছুটা পড়েছেই। এইখানেই অক্টোবর বিপ্লবের মূল সাফল্য। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, আজকের বিশ্বায়িত বাজার অর্থনীতিতে সেই প্রভাব আর কতটুকুই বা অবশিষ্ট রয়েছে। অবশিষ্ট যতটুকুই থাকুক আর নাই থাকুক, ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সবচেয়ে বড়ো রেফারেন্স হিসাবেই অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা রয়ে যাবে আরও বহু শতক।

একটি কথা মানতেই হবে, সকল মানুষের জন্যে সমান অধিকার ও সম সুযোগ, এই ধারণাটি মানুষের প্রত্যয়ে গেঁথে দিতে পেরেছিল মহান অক্টোবর বিপ্লবেরই সুদূরপ্রসারী অভিঘাত। বিশ্বের যে কোন প্রান্তেই হোক, আজকের মানুষ এই কথাটি বিশ্বাস করে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই। সেই অধিকার ও সুযোগ কে কি ভাবে বাস্তবায়িত করবে, বা আদৌ করতে সক্ষম হবে কিনা, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এই ধারণাটির নৈতিকতা নিয়ে আজ আর কেউই কোনভাবেই সন্দিহান নয়। বিগত একশ বছরে এইখানেই অক্টোবর বিপ্লবের প্রাণভোমরা সক্রিয় হয়ে থেকেছে। তাই এই বিপ্লবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলতে চান, বুঝতে হবে জীবনবাস্তবতার সাথে তাদের নাড়ীর যোগ বিলুপ্ত। আবিশ্ব ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির জৌলুসে বিমুগ্ধ হয়ে আজকের দিনে যারা অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতাকেই নস্যাৎ করে দিতে চান, বুঝতে হবে তাদেরও চোখ বন্ধ। বন্ধ বিশ্বায়নের ঠুলিতেই। বিশ্বায়নের এই ঠুলির বিরুদ্ধেই সরব হওয়ার সময় এসেছে আজ। বিশ্বায়নের এই ঠুলিতে অন্ধ হয়ে আবিশ্ব ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক হয়ে পড়ার সর্বগ্রাসী প্রভাব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠারও সময় এসেছে আজ। আর সেই সচেতনতার অন্যতম আয়ুধ হয়ে ওঠার ক্ষমতা নিয়েই ইতিহাসের যুগসন্ধিকালের অন্যতম সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে শতবার্ষিকীর এই অক্টোবর বিপ্লব।

অক্টোবর বিপ্লব নামান্তরে যা নভেম্বর বিপ্লব নামেও পরিচিত, নিয়ে একটি তথ্যপূর্ণ লেখা উপহার দিয়েছেন ইমাম গাজ্জালী। রংরুটের এই সংখ্যায়। এই সংখ্যায় রংরুটের সাথে মুখোমুখি আলাপে আমরা আমাদের সাথে পেয়েছি জার্মান প্রবাসী ব্লগার জোবায়েন সন্ধি, কবি ও লেখক নাসির ওয়াদেন ও অবসরপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ সুমেরু রায়চৌধুরীকে। এবারে রম্যরচনায় অংশ নিয়েছেন গুজরাট প্রবাসী প্রযুক্তিবিদ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য ও কলকাতানিবাসী চিকিৎসক সুসাহিত্যিক সোনালি পুপু। বিস্মৃতপ্রায় সঙ্গীতশিল্পী কেদার ভট্টাচার্যের জীবন ও সাধনা নিয়ে লিখেছেন শিল্পীর নাতনী কবি সুমনা পাল ভট্টাচার্য। নাট্য ব্যক্তিত্ব ও অন্যনিষাদ পত্রিকার প্রাণপুরুষ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বাংলা নাটকের তিনটি ভিন্ন যুগের তিন দিকপাল অভিনেত্রীর জীবন ও সাধনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ সংবেদনশীলতায়। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। নানান স্বাদের আটটি গল্প দিয়ে এবারের সংখ্যাটি ভরিয়ে তুলেছেন, সুদূর কানাডা থেকে শাখা নির্ভানা। মার্কিননিবাসী কথাসাহিত্যিক মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী, তরুণ তুর্কী সৌহার্দ্য ইকবাল। কলকাতানিবাসী কবি শাশ্বতী সরকার, কথাসাহিত্যিক আইভি চট্টোপাধ্যায়, শুভব্রত দাশগুপ্ত এবং ঢাকা নিবাসী সাহিত্যিক ম্যারিনা নাসরীন ও কবি শাকিলা তুবা। নারীবাদ ও নারী বিষয়ে কলম ধরেছেন সুদূর কানাডা থেকে রওশন আরা বেগম, মার্কিন ষুক্তরাস্ট্র থেকে রাবেয়া রাহীম, কলকাতা থেকে অরুণিমা মণ্ডল দাস ও প্রাবন্ধিক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন অলভ্য ঘোষ ও বিশিষ্ট লেখক ও প্রকাশক শামসুজ্জাহান মানিক, আবিশ্ব মুসলিম বিদ্বেষ ও ধর্ম ও জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে। এবারের প্রচ্ছদ নিবন্ধে কলম ধরেছেন শামসুজ্জাহান মানিক। তাঁর কাছেও আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। প্রতিবারের মতোই আমরা চেষ্টা করেছি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে আলোচনা করার। যাঁরা এখনো সমাজ সচেতন থেকে মানুষের সার্বিক সুস্থতার অভিমুখে চিন্তাভাবনা করে চলেন, আমাদের আশা তাঁদের প্রত্যাশা পুরণে সমর্থ্য হবে রংরুটের বর্তমান সংখ্যার সম্ভার।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন