সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন – ভারতীয় চলচ্চিত্রের
তিনটি পৃথক ঘরানা । সত্যজিৎ রায় বাস্তবের চলচ্চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেন সাহিত্যকে
আশ্রয় করে, ঋত্বিক ঘটকের
সিনেমায় দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ক্রোধ আর মৃণাল
সেনের সিনেমায় কঠোর বাস্তবের সঙ্গে যৌবনের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে নেওয়া
চিত্রভাষ্য, আর্থ-সামাজিক
পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানুষের সংকটময় রূপের বিশ্লেষণ । জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের সঙ্গে
সিনেমার আর্টের সমস্ত দিকগুলির সংমিশ্রণ মৃণাল সেনের সিনেমায়, ছবির গল্পের তলে আর এক স্তরের গল্প বলেছেন
যেন তাঁর সিনেমায় । শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি
বুঝতে চেয়েছেন নিজের মত করে আর ধরে রেখেছেন তাঁর সিনেমায় । ঋত্বিক ঘটক চলে গেছেন
১৯৭৬এ, সত্যজিৎ রায় ১৯৯২এ, ৯৪ বছরে পা দিয়ে মৃণাল সেন এখনও রয়েছেন
আমাদের মধ্যে । শেষ ছবি করেছেন ‘আমার ভুবন’ ২০০২এ । জীবন ও শিল্পের অবিরাম প্রবাহ বয়ে
চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বাংলা সিনেমার ত্রয়ী
সত্যজিৎ - ঋত্বিক – মৃণাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্য়ায়
শিরোনামে কোন ধাঁধা নেই । পাঠকমাত্রই বুঝবেন
বাংলা সিনেমার ত্রয়ীর এই তিনজন কারা । স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের কাছে যেমন বাংলা
কথাসাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায় –
বিভূতিভূষণ
– মাণিক -তারাশঙ্কর, থিয়েটারের ক্ষেত্রে যেমন শম্ভূ মিত্র – উৎপল দত্ত – অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রটিও
এক ত্রয়ীর সৃজনবৈভবে উজ্বল – সত্যজিৎ রায় -
ঋত্বিক ঘটক – মৃণাল সেন ।
স্বাধীনতার পরে প্রায় একই সময়ে তাঁদের বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পে পা রাখা , একই সময়ে এই ত্রয়ীর সৃষ্টির ঊড়ানে চেপেই
বাংলার এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে গৌরবময় অবস্থান ।
সাতচল্লিশে দেশ যখন স্বাধীন হল বাংলা সবাক
চলচ্চিত্রে বয়স মাত্র ১৫ বছর আর আগের ১৩ বছরের নির্বাক যুগের হিসাব ধরলে সাকুল্যে
বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর । স্বাধীনতার আগের ১৫টা বছর ছিল
বাংলা চলচ্চিত্রে ডালপালা ছড়ানোর কাল,
আর
স্বাধীনতার পাঁচ বছর আগেই শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রে নবচেতনার ভাবনা । গত শতকের
চল্লিশের দশকটা ছিল বাংলার সারস্বতভূমির মহা সৃজনকাল । সাহিত্যে তিন
বন্দ্যোপাধ্যায় – তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,
নৃত্যকলায়
উদয়শঙ্কর, সঙ্গীতে শচীনদেব বর্মন
প্রমুখ উজ্বল জ্যোতিষ্কদের পাশে শম্ভু মিত্র,
হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর মত
নবীনদের দীপ্তিতে আলোকিত বাংলার সারস্বতভূমি,
শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের
সৃজনভূমিতে নতুন চেতনা ও বোধের স্পর্শ,
যদিও
বাংলা চলচ্চিত্রে এই নবচেতনা ও বোধের ছোঁয়া তখনও লাগেনি । তখনকার বিশ্ব
চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভারতীয় সিনেমার মানের কোন তুলনাই হয় না। চলচ্চিত্র যে এক
শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম, এর যে জীবনের
সাথে যোগ থাকতে পারে, জীবনের মূল
সত্যকে যে চলচ্চিত্র স্পর্শ করতে পারে এই সত্যটা সেই সময়ের চলচ্চিত্রকারদের ছিল না
। দেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম,
আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে মানবতা ধ্বংসি ফ্যাসিবাদের উথ্বান,
তেতাল্লিশের
মন্বন্তরে কলকাতার রাজপথে মৃত্যু-মিছিল,
ভাতৃঘাতি
দাঙ্গা – এসব কিছুরই বিন্দুমাত্র
ছায়াপাত তখকার বাংলা সিনেমায় পড়েনি । ১৯৩৬এ স্থাপিত ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ তার ইস্তাহারে আহ্বান জানালো “ আমাদের বিপর্যস্ত সমাজের দাবি মেনে
বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে । আমরা চাই জনসাধারণের সঙ্গে
সর্ববিধ কলার নিবিড় সংযোগ” । তখনকার বাংলা
সিনেমার এসব নিয়ে কোন হেলদোল ছিল না । আবার এই চল্লিশের দশকেই এই শক্তিশালী
শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে নতুনতর ভাবনা চিন্তার সূত্রপাত হয় একঝাঁক তরুণের উদ্যোগে, সূচনা হয় ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন । সত্যজিৎ
রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার,
চিদানন্দ
দাশগুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ
ফিল্ম সোশাইটি আন্দোলন থেকে উঠে এলেন । ১৯৪৭এ গঠিত হল ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ । তাঁরা নিজেদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের ধ্রুপদি
ছবিগুলি দেখে নিজেদের সমৃদ্ধ করতেন আর ভালো সিনেমা নির্মাণের প্রস্তুতি নিতেন । পঞ্চাশের দশকে পৌছে আমাদের চলচ্চিত্র-ভাবনা, সিনেমার ধ্যানধারনার সবটাই যেন ওলটপালোট হয়ে
গেলো। সূচনা হল সমান্তরাল সিনেমা আন্দোলন এই ত্রয়ীর মহাকীর্তিতে ভর করে ।
সত্যজিৎ রায় : জীবন
ও সৃষ্টি
পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন বাংলা
শিশু-কিশোর সাহিত্যের পিতৃপুরুষ আর পিতা সুকুমার ছিলেন ‘শিশুসাহিত্যের প্রবাদ-পুরুষ’ এই পরিচয়ের বাইরে এদেশে আধুনিক মূদ্রন
প্রযুক্তি প্রয়োগের পথিকৃত ও লন্ডনের ‘ফেলো অফ রয়াল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত সন্দেশ পত্রিকার সমস্ত ছবি
সুকুমারই আঁকতেন । পূর্বজ দুই পুরুষের সমস্ত প্রতিভার অত্যাশ্চর্য সম্মিলন ঘটেছিল
সত্যজিতের মধ্যে । পিতার মৃত্যুর সময় সত্যজিৎ ছিলেন দু বছর চার মাসের শিশু আর
পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয় তাঁর জন্মেরও ছ বছর আগে ।
সুকুমার রায়ের অকাল মৃত্যুর পর ওদের পরিবারে
বিপর্যয় নেমে আসে । পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক ব্যবসা ‘ইউ রায় এন্ড সন্স’ দেউলিয়া ঘোষীত হয় এবং নামমাত্র মূল্যে নিলামে বিক্রি হয়ে যায় । পারিবারিক ভাঙনের ফলে
শিশুপুত্র সত্যজিৎকে নিয়ে মা সুপ্রভা আশ্রয় নেন ভবাণীপুরের বকুল বাগানে ভাই
প্রশান্ত কুমার দাসের গৃহে । সুপ্রভা ‘বিদ্যাসাগর
বাণীভবন বিধবাশ্রম’এ সেলাইএর কাজ
করে সংসার নির্বাহের চেষ্টা করেন । চাকুরী নেন একটি স্কুলে এবং সেলাইএর কাজ করেন ।
সত্যজিৎ মাতুলালয়েই বেড়ে ওঠেন । বালিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন ১৯৪০এ । কলেজ ছাত্র
থাকাকালীন চলচ্চিত্র ও সংগীত বিষয়ে আগ্রহ জন্মায় তাঁর । মার্চ ১৯৪৯এ বিবাহ করেন
সম্পর্কে মামাতো বোন বিজয়া দাসকে ।
মায়ের ইচ্ছা, পুত্র তাঁর গুরুদেবের বিশ্বভারতীতে শিক্ষা লাভ করুক, সত্যজিতের তেমন আগ্রহ ছিল না কলকাতার টানে ।
মায়ের ইচ্ছাতে সত্যজিৎ সম্মত হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনে ভর্তি হতে । ১৯৪০এর ১৩
জুলাই ভর্তি হলেন ‘কলাভবন’এ । সেখানে আচার্য নন্দলাল বসু ও বিনোদ
বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে ফাইন আর্টএর শিক্ষা গ্রহণ করেন । তাঁর আগ্রহ ছিল
কমার্শিয়াল আর্টস’এ দক্ষতা অর্জন
করা । বিশ্বভারতীতে পাঁচ বছরের কোর্সে ভর্তি হয়েও বিশ্বভারতীতে কমার্শিয়াল আর্টস
শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় সত্যজিৎ,
আচার্য
নন্দলালের অনুমতি নিয়ে বিশ্বভারতীতে তার শিক্ষা শেষ করেন তিনবছর পরেই । ১৯৪৩এর
এপ্রিলে কলকাতায় প্রখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারএর অফিসে ‘জুনিয়ার ভিসুয়ালাইজার পদে চাকরী পেয়ে যান, মাস মাইনা ৮০টাকা । পরে ওখানে পদোন্নতি হয়ে
আর্ট ডিরেক্টর হয়েছিলেন ।
গত শতকের চল্লিশের দশকটা ছিল বাংলার
সারস্বতভূমির মহা সৃজনকাল । সত্যজিৎ রায়ের
মনে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনা বাসা বাঁধছে তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের বয়স সবে
ত্রিশ পেরিয়েছে (প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনী চিত্র দাদাসাহেব ফালকের ‘হরিশচন্দ্র’/ ১৯১৩) আর বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হয়েছে মাত্র ১৫ বছর আগে
(১৯৩১) । হয়তো সেই কারণেই চলচ্চিত্রের
ক্ষেত্রটিই হয়ে উঠেছিল তাঁর অন্বিষ্ট । তখনকার বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে ভারতীয়
সিনেমার মানের কোন তুলনাই হয় না। চলচ্চিত্র যে এক শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম, এর যে জীবনের সাথে যোগ থাকতে পারে, জীবনের মূল সত্যকে যে চলচ্চিত্র স্পর্শ করতে
পারে এই সত্যটা সেই সময়ের চলচ্চিত্রকারদের ছিল না । সত্যজিৎ রায়ই ‘পথের পাঁচালী’র মধ্য দিয়ে আমাদের তা বোঝালেন । এই অবদান সত্যজিৎ রায়কে
আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে অনন্য স্রষ্টার আসনে বসিয়েছে । ভালো সিনেমা নির্মাণের ভাবনা তাঁর মনে বাসা
বাধে চল্লিশ দশকের মধ্যভাগে । ১৯৪৮এ কলকাতার ইংরাজি দৈনিক ‘দি স্টেটসম্যান’এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন “দি র মেটেরিয়াল অফ সিনেমা ইজ লাইফ ইটসেলফ ।
ইট ইজ ইনক্রেডিবল দ্যাট আ কাউন্ট্রি দ্যাট হ্যাস ইনস্পায়ার্ড সো মাচ পেইন্টিং এন্ড
মিউজিক এন্ড পোয়েট্রি শুড ফেইল ট মুভ সিনেমা মেকার । হি হ্যাজ ওনলি টু কিপ হিজ আইস
ওপেন” (উদ্ধৃতি সূত্র :’সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রে ও নেপথ্যে’/অসীম সোম) । ১৯৪৭এর অগস্টে গঠিত ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’তে বিশ্বখ্যাত সিনেমাগুলি সংগ্রহ করে দেখতেন, সিনেমা শিল্পের নানান দিক সম্পর্কে নিজেদের
সমৃদ্ধ করতেন । সত্যজিৎ এই প্রসঙ্গে লিখেছেন ‘সাধারণত আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে আমরা ১৬ মিলিমিটারের
ফিল্ম দেখতাম এবং যেসব ফিল্ম দেখতাম তার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতাম নিজেদের
মধ্যে। আমরা প্রথম দেখেছিলাম আইজেনস্টাইনের ক্ল্যাসিক ছবি ‘ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’। শোনা যায় বিশ্ববন্দিত এই ছায়াছবি ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন’ পঁচিশ তিরিশবার দেখেন । ফিল্ম সোসাইটি
আন্দোলনের সূত্রে এইসময় তাঁর পরিচিতি ঘটে প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাক
রেনোয়াঁর সঙ্গে পরিচিতি ঘটে । রেনোয়া তখন তাঁর ছবি তাঁর ‘দ্য রিভার’ এর কিছু অংশের সুটিং’এর জন্য কলকাতায়
এসেছিলেন । সত্যজিৎ রেনোয়ার সুটিং দেখেছিলেন এবং কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
করেছিলেন ।
সত্যজিৎ যখন জে ডি কিমারের বিজ্ঞাপন
এজেন্সিতে কাজ করছেন তখন সেখানে ভালো পদে কাজ করতেন ডি কে গুপ্ত, যিনি ‘সিগনেট প্রেস’ নামে প্রকাশনা সংস্থা খুললেন আর সিগনেট
প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মাণের দায়িত্ব দিলেন সত্যজিৎকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে ।
সিগনেট হয়ে উঠলো বাংলা পুস্তকের অভিজাত
প্রকাশনা সংস্থা । জীবনন্দ দাস, সুধীন্দ্রনাথ
দত্তর কবিতার বই, জওহরলাল নেহেরুর
‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’, জিম করবেটের ‘কুমায়ূনের মানুষখেকো বাঘ’এর বইয়ের প্রচ্ছদ সিগনেট প্রেসকে প্রভুত খ্যাতি এনে দিল ।
চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের প্রথমে ভেবেছিলেন চিত্রনাট্যকার হবেন। ১৯৪৬এ ‘ঘরে বাইরে’ সহ কয়েকটি চিত্রনাট্য
চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন । ‘ঘরে বাইরে’র চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন পরিচালক হরিসাধন
দাশগুপ্তর জন্য । সে ছবি অবশ্য হয়নি,
হয়েছিল
তাঁর পরিচালনায় অনেক পরে, ১৯৮৪তে ।
১৯৫০এ সত্যজিৎ যে বিজ্ঞাপন কোম্পানীতে
চাকুরী করতেন তারা তাঁকে লন্ডনে কাজ করতে পাঠান । লন্ডনে তিনি ছিলেন ৬ মাস । এই ৬
মাসের ইউরোপ প্রবাস তাঁর মধ্যে সিনেমা নির্মাণের ভাবনাটি আরো উস্কে দেয় । সত্যজিৎ
তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন ‘ কলকাতায় যে সব
ছবি দেখতে পাইনি এমন পচানব্বইটি ছবি দেখলাম পাঁচ মাসে । যেদিন লন্ডনে পৌছালাম
সেদিনই দুটো ছবি দেখলাম কার্জন সিনেমায় ‘এ নাইট এট দি
অপেরা’ ও দি বাইসাইকেল থিফ’ । ঐ ছবি দেখেই আমি টের পেলাম স্টুডিওর বাইরে শুধু অপেশাদার
অভিনেতা নিয়ে পরিচালক কী ঘটাতে পারেন । ভাবলাম যা ইতালিতে হতে পারে, তা কলকাতাতেও হতে পারে ...। লন্ডনে ‘দি বাইসাইকেল থিফ’ দেখে আমি স্থির করলাম নিওরিয়ালেস্টিক মেথডে
আমি ‘পথের পাঁচালী’ করবো । এদিকে, পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেপু’ প্রকাশ করবে সিগনেট, তার ছবি আঁকার কথা সত্যজিতের । লন্ডন থেকে
ফেরার পথে জাহাজে বসে ছবিগুলি আঁকলেন । আর এই ছবিগুলিই হল ‘পথের পাঁচালী’র এক একটি দৃশ্যের ফ্রেম - পথের পাঁচালীর
প্রকৃত চিত্রনাট্য । ‘আম আঁটির ভেপু’র ছবি আঁকার সূত্রেই তাঁর প্রথম ‘পথের পাচালী’ পড়া । পড়ে অভিভুত হলেন এবং নিশ্চিত হলেন এই কাহিনী নিয়ে
একটা ভালো ছায়াছবি করা যায় ।
চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করে, প্রায় পাঁচশ স্কেচ এঁকে অনেক প্রযোজক, পরিবেশককে দেখালেন । কিন্তু কেউই এগিয়ে এলেন
না, গুরুত্বই দিলেন না । এমন
কি ‘নিউ থিয়েটার্স’ বাংলা ছায়াছবির ক্ষেত্রে যারা পথিকৃত, যাদের ভারতজোড়া খ্যাতি, তারাও না । তবুও সত্যজিতের অনন্য জেদ আর
প্রত্যয় হার মানলো না । লিখছেন “
১৯৫২
সালে স্থির করলাম যেমন করে হোক এ ছবি আমি করবোই” । তারপর সে এক
ইতিহাস । মা ও স্ত্রীর অলঙ্কার, নিজের বইপত্র, বিক্রি করে, বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে
ছবির কাজ কিছুটা এগোলো । এক তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হওয়ার পর দেখলেন আর টাকার
জোগান নেই । হতোদ্যম হয়ে পড়লেন । সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী
সহানুভুতিশীল হয়ে এগিয়ে না এলে পথের পাঁচালী সম্পূর্ণ হত না, বিশ্ব চলচ্চিত্রে ভারতীয় চলচ্চিত্র
শিল্পকলার অবদানও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হত না কোন দিন । শেষ চেষ্টা হিসাবে সত্যজিৎ
মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি একটা আবেদন জমা দিতে
বললেন । প্রখ্যাত নাট্যকার মন্মথ রায় তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি
উপদেষ্টা । তিনি অসমাপ্ত ছবিটি দেখলেন এবং উছ্বসিত প্রসংশায় আবেদনের অনুকুলে মত
দিলেন । কিন্তু সরকারী আমলাতান্ত্রিক নিয়মে যা হয়, আবেদনটি মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যাবার আগে
তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত আমলা পি এস মাথুরের কাছে গেলো । মাথুর
লিখলেন এখন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রচার চলছে, সেই প্রচার অভিযানের মধ্যে এমন দুঃখ-দারিদ্রের ছবি
দেখালে সরকারী প্রচার অভিযান ব্যর্থ হবে ।
মাথুরের বিরোধিতার ফলে বিধানচন্দ্র নিজে অসমাপ্ত’ ‘পথের পাঁচালী’
দেখলেন
এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিনেট অনুমোদন নিলেন যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছবিটির প্রযোজনার
দায়িত্ব নিল এবং পরিবেশকের দায়িত্ব দেওয়া হল ‘অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন’কে । ছবি শেষ হল,
পরিবেশক
ও ঠিক হয়েছে কিন্তু কলকাতায় কোন চিত্রগৃহ পাওয়া গেলো না প্রদর্শনের জন্য । তামাম
বিশ্ব বরণ করে নিয়েছিল যে চলচ্চিত্রকে ‘শ্রেষ্ঠ মানব
দলিল’ রূপে, সেটি তার নিজের শহরে মুক্তি পেলো না, প্রথম মুক্তি পেল নিউ ইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’এ –
১৯৫৫র
এপ্রিলে । কলকাতায় মুক্তি পেল ১৯৫৫’র ২৬শে অগস্ট ।
তারপর বিশ্বচলচ্চিত্র ভুবনে আলোড়ন ফেলে দেওয়া সব বৃত্তান্ত বলে শেষ করা যাবে না ।
মজার কথা, ‘পথের পাঁচালী’র রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে
স্রষ্টা সত্যজিৎ আমন্ত্রিত ছিলেন না । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে পুরষ্কার
নিয়েছিলেন সেই আমলা মাথুর ।
পথের পাঁচালী মুক্তি পাবার পর মুম্বাই
চলচ্চিত্রের খ্যাতনাম্নি অভিনেত্রী নার্গিস এবং আরও কেউ কেউ বলেছিলেন সত্যজিৎ পথের
পাঁচালীর মধ্যদিয়ে বিশ্বের দরবারে ভারতের দারিদ্রকেই তুলে ধরেছেন । এই সব অর্বাচীন
অপলাপ নিশ্চিতভাবেই তাঁদের অগৌরবের
মাত্রাই বাড়িয়েছে, সত্যজিতের
বিরাটত্বকে তিলমাত্রও খাটো করতে পারেনি । বাস্তবের দারিদ্র্যকে শিল্পের সত্যে
প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সত্যজিৎ । ‘পথের পাচালী’র হরিহর বুঝতে পারেননি যে যুদ্ধোত্তর
গ্রামীণ সমাজেও বেঁচে থাকার পদ্ধতিরও বদল ঘটেছে । হরিহর চেয়েছিল পূজো-পাঠ করেই
সংসার চালাতে, চেয়েছিল অপুও
তাই করবে এটাই হরিহরের ট্রাজেডি । অপু ট্রিলজিতে হরিহরের ট্রাজেডি এবং সেই
পরিমন্ডল থেকে অপুর মুক্তির প্রয়াস আমাদের উত্তরণেরই চিত্র-ভাষ্য । ‘অপু ট্রিলজি’ থেকে ‘দেবী’, ‘জলসাঘর’ ‘জনঅরণ্য’ পেরিয়ে ‘সদগতি’,
‘শাখা-প্রশাখা’, ‘গণশত্রু’ থেকে শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ পর্যন্ত মানুষের উত্তরণের কথাই সত্যজিৎ বলে
গিয়েছেন ।
সত্যজিৎ রায়ের ২৮টি কাহিনী চিত্রের মধ্যে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘নায়ক’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ও ‘হীরক রাজার দেশে’ এই পাঁচটি ভিন্ন সবক’টি ছবির কাহিনীর উৎস কথাসাহিত্য ।
রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, পরশুরাম, নরেন্দ্রনাথ
মিত্র, শঙ্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প ও উপন্যাস
তাঁর কাহিনীচিত্রগুলির উৎস । তিনি ক্যামেরায় গল্প বলেছেন নিজের মত করে । আপন
জীবনবোধ, ইতিহাস জিজ্ঞাসা ও আপন
শিল্পদৃষ্টিতে সেইসব কাহিনীগুলিকে দর্শকের অনুভুতিতে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথ অভিনেতা মুরারী ভাদুড়ীকে এক পত্রে লিখেছিলেন “চলচ্চিত্র এখনো সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে
চলেছে – তার কারণ কোন রূপকার আপন
প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারেনি”(সূত্র ‘সত্যজিৎ কথা : চলচ্চিত্রে ও নেপথ্যে’ / অসীম সোম )। সত্যজিৎ সেটা করলেন, আর তাই তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি হয়ে
উঠেছে ‘সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ।
চিত্রনাট্য থেকে টাইটেল ও প্রচারের বিজ্ঞাপন রচনা সবই তাঁর নিজের হাতের, নিজের শিল্পবোধ ও ভাবনায় । সঙ্গীতের প্রয়োগ
তাঁর ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছে । চলচ্চিত্র পরিচালনায় নামার আগেই নিজেকে
তৈরি করে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ চিত্রকলা ও সঙ্গী বিষয়ে । পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি
তাঁর ছিল আবাল্য আকর্ষণ । সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও অন্বেষণ শান্তিনিকেতন পর্ব
থেকেই, । কলাভবনে শিক্ষাকালীন তাঁর সঙ্গীত চর্চার
পরিধিরও বিস্তার ঘটেছিল । ‘পথের পাঁচালী’ সহ প্রথম ৬টি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন
রবিশঙ্কর, বিলায়েৎ খান ও আলি আকবর
। কিন্তু ছবিগুলির আবহ সঙ্গীতের প্রয়োগ নানান দ্ররশ্যের ‘মুড’
নির্মাণে
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের উপস্থিতি দর্শকরা বুঝতে পারেন । পথের পাঁচালীতে অশীতিপর
চূণীবালার (ইন্দীর ঠাকুরন) কন্ঠে ‘হরি দিন তো গেলো
সন্ধ্যা হল পার করো আমারে’ গানটির প্রয়োগ
আমাদের চমকিত করেছিল । ক্রমে সত্যজিৎ উপলব্ধি করেন তাঁর ছবির সঙ্গীত পরিচালকরা
পেশাগতভাবে খ্যাতকীর্তি হলেও চলচ্চিত্র দৃশ্যের মুড, পরমিতি বোধ ও পরিচালকের ভাবনা বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়
না। বিশ্বের সব মহৎ চিত্র পরিচালকই মুখোমুখী হয়েছেন এই দ্বন্দ্বের । চার্লি
চ্যাপলিন, আইজেনস্টাইন নিজেই
সঙ্গীত পরিচালনা করতেন নিজের ছবির । তাই ১৯৬০এর পর বাইশটি ছবির সঙ্গীত রচনার
দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছিলেন । এই পর্বেই আমরা পেয়েছি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এর মত মিউজিকাল ফ্যান্টাসি । ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালনার জাতীয়
পুরষ্কার পায় । অনেক আগে ‘জলসাঘর’(১৯৫৮) মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ
সঙ্গীতের পুরষ্কার পায় (সঙ্গীত পরিচালনা –
বিলায়েৎ
খান)
যুবা বয়স থেকে প্রৌঢ়ত্ব সত্যজিতের এই পাঁচ
দশকের জীবনকাল স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,
তেতাল্লিশের
মন্বন্তর, দেশ বিভাগ, বাম আন্দোলন, জরুরী অবস্থার কৃষ্ণপ্রহর, নকশাল আন্দোলন ইত্যাদি অনেক উত্তাল সময়ের সাক্ষী । কিন্তু
সংস্কৃতি ভাবনায় বাম বা দক্ষিণ কোন দিকেই তাঁর ‘কমিটমেন্ট’
ছিল
না । তাঁর কমিটমেন্ট ছিল শিল্পের প্রতি । জীবনমনস্ক সত্যজিতের কাছে শিল্পচর্চাই
ছিল জীবনচর্যা ।
আমার স্মৃতিতে আছে, ১৯৬২র চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময় উগ্র
জাতীয়তাবাদ ও কমিউনিষ্ট বিরোধীতার ঢেউ উঠেছিল । শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটা অংশ সেই
উগ্র জাতীয়তাবাদের ঢেঊয়ে গা ভাসিয়েছিলেন । এই আবহে কলকাতার একটি দৈনিকে, সম্ভবত আনন্দবাজা্রে সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা
হয়েছিল ‘সত্যজিৎ রায় নীরব কেন’। উদ্দেশ্য পরিস্কার । তাঁর মত বিশ্ববন্দিত শিল্পীর পেছনেও
কিছু দেগে দেওয়া । এইসব ব্যাপার তখন বিশ্ববন্দিত সত্যজিৎকে বিন্দুমাত্র বিচলিত
করতে পারেনি । জওহরলাল নেহেরুর অনুরোধে সীমান্ত যুদ্ধ নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের
প্রস্তাবে আগ্রহ দেখাননি, ইন্দিরা গান্ধী – সিদ্ধার্থ রায় জমানায় তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য
পদের প্রস্তাবও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । নিজ বিশ্বাস, প্রত্যয় আর নিজস্ব ধ্যানধারণা থেকে কোন
প্ররোচনাই তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি ।
১৯৫৫ থেকে ২৩এ এপ্রিল ১৯৯২এ মৃত্যু পর্যন্ত
৩৭ বছরে তিনি নির্মাণ করে গেছেন ২৮টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র, ৫টি তথ্যচিত্র, ৩টি টেলি ফিল্ম । ১৯৫৬তে কান চলচ্চিত্র
উৎসবে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি থেকে ১৯৯২এ মৃত্যুশয্যায় অস্কার সম্মাননা পর্যন্ত
দেশে বিদেশে কত রাষ্ট্রীয় সম্মাননা,
কত
প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মাননা জানিয়ে গৌরবান্বিত হয়েছে তার সব
বৃত্তান্ত একটি স্বল্প পরিসরের নিবন্ধে দেওয়া সম্ভব নয়, মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করলাম - ভারত
সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘ভারত রত্ন’ (১৯৯২),
চলচ্চিত্রের
সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’(১৯৮৫) পুরষ্কার, ম্যাগসেসাই’পুরস্কার (১৯৬৭),
ফ্রান্সের
সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘লিজিয়ন অফ অনার’ (১৯৮৭),
বিশ্বভারতীর
‘দেশিকোত্তম’(১৯৭৮) ।
১৯৮৩তে ‘ঘরে বাইরে’
ছবির
চলচ্চিত্রায়ন চলার সময়ে বড় রকমের হৃদরোগে আক্রান্ত হন । পুত্র সন্দীপ রায় তাঁর
পরামর্শ নিয়ে ছবিটি শেষ করেন । বিদেশে তাঁর হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয় এরপর প্রায়
চিকিৎসকের পরাপর্শে তিন বছর তিনি কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেননি । ১৯৮৭তে পিতা
সুকুমার রায়কে নিয়ে একটি তত্যচিত্র শেষ করার পর অসুস্থ্য শরীরে পরের তিন বছরে
তিনটি ছবি করেন ‘গণশত্রু’(১৯৮৯),
‘শাখাপ্রশাখা’(১৯৯০) এবং শেষ ছবি ‘আগন্তুক’(১৯৯১) । অসুস্থ্যতার কারণে এই তিনটি ছবিই পুরোপুরি ইন্ডোর
সুটিং করেই সম্পন্ন করেন । চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতে এই তিনটি ছবিতে সত্যজিৎকে পাওয়া
যায়নি আগের মত । ১৯৯২এ আবার তাঁর হৃদযন্ত্রে জটিলতা ধরা পড়ে । হাসপাতালে ভর্তি হন, কিন্তু আর সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসতে পারেননি ।
১৯৯২এর ২৩শে এপ্রিল চিরতরে চলে যান এই বিশ্ববরেন্য বাঙালি সত্যজিৎ রায়এবার
একটা পরিচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালিয়ানা, স্বচ্ছ চিন্তাধারা ও সবল মানসিকতা ছিল
সত্যজিৎ রায়ের । তিনি ছিলেন একান্তভাবেই কলকাতা প্রেমি বাঙালি । একটি ছাড়া বাংলা
ভিন্ন অন্য ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি,
বাংলা
ও বাঙ্গালিজীবনই তাঁর তাবৎ চলচ্চিত্রকর্মের সূত্র । তাদের নিয়েই ক্যামেরায় ছবি এঁকেছেন
সত্যজিৎ রায় । পথের পাঁচালী থেকে আগন্তুক, বিজ্ঞাপন এজেন্সির গ্রাফিক ডিজাইনার, সিগনেট প্রেসের প্রতিষ্ঠিত প্রচ্ছদ শিল্পী
থেকে ফেলুদা, শঙ্কু, সঙ্গীত থেকে কল্পবিজ্ঞান এই দীর্ঘ পথ
পরিক্রমায় তাঁর জীবন-অন্বেষা ও সৃজন বৈভব আমাদের চিরকালীন সম্পদ । চলচ্চিত্র নিয়ে
সত্যজিতের বিশ্বজয় যেন বাঙ্গালিরই বিশ্ববিজয় । বাঙ্গালির অনেক কিছু নেইয়ের মধ্যে
আছেন রবীন্দ্রনাথ, আছেন সত্যজিৎ
রায় । রবীন্দ্রনাথের পর সত্যজিৎ রায়ই তো বাঙালির সেরা আইকন ।
ঋত্বিক কুমার ঘটক :
সমান্তরাল সিনেমা আন্দোলনের এক অবিস্মরনীয় নাম
কোথাও কি স্থিতধি হতে পেরেছিলেন ঋত্বিক ? না পারেননি, না থিয়েটারে,
না
চলচ্চিত্র নির্মাণে । পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষকতাও ছেড়ে দিয়েছিলেন । সময়ই
তাঁকে স্থিতধি হতে দেয়নি । প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ (১৯৫২) তো নিজের জীবদ্দশায় মুক্তির ব্যবস্থাই
করতে পারননি । বোম্বাই গিয়েছিলেন,
সেখানে
মধুমতী, মুসাফির এবং আরো
অনেকগুলি বানিজ্য সফল ছায়াছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন । কিন্তু সেখানেও থাকেন নি
। ছ’বছর পরে দ্বিতীয়
ছবি অযান্ত্রিক অর্থকরী সাফল্য পেলো না । ‘বাড়ি থেকে
পালিয়ে’ও তাই । ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০) আর্থিক ভাবে সফল হল, কিন্তু পরের ছবি ‘কোমল গান্ধার’(১৯৬১) নয় । ১৯৬৫তেমুক্তি পাওয়া ছবি ‘সুবর্ণরেখা’ প্রথমে দর্শক আনুকুল্য পায়নি কিন্তু দেশে বিদেশে বহু
পুরস্কার পাওয়ার পর বাঙালি দর্শকরা আর মুখ ফিরিয়ে থাকেননি । তা সত্তেও কোন প্রযোজক
ঋত্বিককে দিয়ে ছবি করাতে এগিয়ে আসেননি,
তাঁর
আপোষহীনতার জন্য । প্রেক্ষাগৃহের টিকিট ঘর
থেকে টাকা না ফেরত এলে প্রযোজকরা এগিয়ে আসবেন না এটা তো সোজা হিসেব ! তাই ১৯৬৫তে ‘সুবর্ণরেখা’ করার পর ৯বছর আর কোন ছবি করতে পারেননি । ১৯৭২এ যান
সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে, শুরু করেন তাঁর
অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র নির্মাণ ‘তিতাস একটি নদীর
নাম’ । তিতাসের পর আর তাঁর শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্ক আর গল্প’ মুক্তি পায় ১৯৭৪এ । সিনেমার প্রতি ঋত্বিকের
পেশাদারী ভালোবাসা ছিল না । চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর ছিলনা কোন ভণিতাও । এক
সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন “ছবি লোকে দেখে।
ছবি দেখানোর সুযোগ যতোদিন খোলা থাকবে,ততোদিন মানুষকে
দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাবো। কালকে বা দশ বছর পরে যদি সিনেমার
চেয়ে ভালো কোনো মিডিয়াম বেরোয় আর দশবছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি সেখানে চলে
যাবো। সিনেমার প্রেমে নেশায় আমি পড়িনি। আই ডু নট লাভ ফিল্ম” ।
নিজের তাবৎ শিল্পকর্মের মধ্যে ঋত্বিকের
অন্বেষণ ছিল এক ‘শিল্পভাষা’র যা দিয়ে মানুষের কাছে পৌছানো যায় ।
লিখেছিলেন “... তেমন ভাষাটি
কিন্তু আছে । খুজিয়া পাইতেছি না । ... বায়োস্কোপে ঐ ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন । ইউরোপ
পারিবে না এ যুগে, আমরা পারিব, যদি খুজি” ।
...
এটুকু
বুঝি, এ ভাষা জন্মাইতে পারে
শুভ্র উত্তাপময় প্রেরণা হইতে । সে প্রেরণা,
মনে
হয়, পেশাদার বায়োস্কোপের
লোকের দ্বারা হইবে না । ... খুব খানিকটা না রাগিলে, খুব ভালো না বাসিলে,
খুব
না কাঁদিলে, এ আদিম ভাষা
কোথা হইতে উঠিবে” ? (ঋত্বিক পত্নী
সুরমা ঘটকের ‘ঋত্বিক’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত) ।
জন্ম ৪ঠা নভেম্বর ১৯২৫ এখনকার বাংলাদেশের
ঢাকায় । পিতা সুরেশচন্দ্র ঘটক, মাতা ইন্দুবালা
দেবী । ১৯৪৭এ দেশ ভাগের পর চলে এলেন ভারতে । দেখলেন দেশভাগ, লাখে লাখে ভিটেমাটি হারানো উদবাস্তু স্রোত, সব থেকেও সব হারানোর যন্ত্রণা । দেশ বিভাগের
হাহাকার আর মাকে (অর্থাৎ দেশ) হারানোর যন্ত্রণা ভাষা খুঁজেছে ঋত্বিকের তাবৎ
শিল্পকর্মে – গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণে ।
৪৭এ ঋত্বিক বাইশ বছরের তরুণ । বাল্য, কৈশোরের দিনগুলি ফিরে দেখতে চেয়েছেন তাঁর
স্মৃতিচারণে “আমার দিন
কাটিয়াছে পদ্মার ধারে, একটি দুঁদে
ছেলের দিন । গহনার নৌকায় মানুষদের দেখিয়াছি,
... জেলেদের দেখিয়াছি ইলশাগুঁড়ির প্রথম বরষায় বেজায় খুশি হইয়া বেসুরো টান মারিত, জল মাখানো হাওয়াতে দমকায় দমকায় ভাসিয়া আসিত
কেমন মনকেমন করা পাগল সুর । স্টীমারে
শুইয়া রাত্রে দোল খাইয়াছি মাতাল নদীর দাপটে,
আর
শুনিয়াছি ইঞ্জিনের ধস-ধস, সারেঙের ঘন্টি, খালাসীর বাঁও না মেলা আর্তনাদ । ... একটা
জীবন প্রণালী, মানুষের এক
বিচিত্র জীবন-প্রবাহ । আর নাই । যদি থাকিত ... দাড়াইতে পারিতাম তাহার উপরে, বলিতে পারিতাম কিছু । এমনভাবে সব কিছুকে বিকৃত
মন লইয়া দেখিতাম না । ভবিষ্যৎকে এত ভয় করিতাম না । দেশের ও মানুষের ভবিষ্যৎকে” । দেশকে হারানো,
সেই
রূপকথাকে হারানোর হাহাকার ছায়াপাত ঘটিয়েছে তাঁর সৃজনকর্মে ।
সিনেমায় এসেছেন পরে, ১৯৫২তে । তার আগে নাটকে, রাজশাহিতে স্কুলজীবন থেকে । চল্লিশের দশক
থেকে কলকাতায় গণনাট্য আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন । এক সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক
জানিয়েছিলেন “নবান্ন’ আমার সমস্ত চিন্তাধারা পালটে দিল । আমি
নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম । আইপিটিএর মেম্বার হয়ে গেলাম । ...নাটক ইমিডিয়েট রিএকশন
তৈরি করে বলে দারুণ লেগেছিল” । (‘সাঁকো থেকে দেখা’ / রথীন চক্রবর্তী – নাট্যআকাডেমি পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ৯৭) । গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে বেরিয়ে শম্ভূ মিত্র ‘বহুরূপী’ গঠন করলে ঋত্বিক ঘটক কিছু দিনের জন্য বহুরূপীতে আসেন । তবু
নাটকের ঋত্বিক ত্রমনভাবে আলোচিত হন না,
তার
থিয়েটারি সীমানা ঢাকা পড়ে গেছে ‘চলচ্চিত্রের
ঋত্বিকে’র আড়ালে । অথচ প্রাথমিক ব্যর্থতার পর ষাট-সত্তর দশকে
তাঁকে নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র-মনন যখন আলোড়িত,
তখনও
নাটক লিখেছেন, থিয়েটার করেছেন । ‘সেই বিষ্ণুপ্রিয়া’র চলচ্চিত্র
সংক্ষেপ নিয়ে লিখেছিলেন নাটক ‘জ্বলন্ত’ । ১৯৭৫এ একটি মাত্র অভিনয় হয় আকাডেমি মঞ্চে । তারপর ১৯৭৬এর ডিসেম্বরে
প্রয়াত হন । থিয়েটার দিয়ে শুরু ঋত্বিকের জীবন আর শেষও থিয়েটার দিয়েই । এর
মধ্যবর্তী যে ঝোড়ো জীবন, তার সাফল্য,ব্যর্থতা, অবক্ষয়, অপচয়, তাকে ছোঁয়া যায় না । তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’ তে ঋত্বিক তাঁর ব্যক্তি জীবন, তার অপচয়, অবক্ষয়, দাম্পত্য বিচ্ছেদ, অপরিমিত মদ্যপানে বিধ্বস্ত জীবনকেই
চলচ্চিত্রায়িত করেছেন । অভিনয়ও করেছেন । যেন ছায়াছবির নীলকন্ঠ বাগচীর মধ্যে
নৈরাজ্যিক ঋত্বিক-জীবনের আক্ষরিক অনুবাদ সেলুলয়েডে ।
ঋত্বিকের যে নৈরাজ্যিক জীবন, বলা ভালো জীবনের অপচয় তার সূত্র দেশ বিভাগ ও
ছিন্নমূল হওয়া । ঋত্বিক-জীবনের বিদগ্ধ আলোচকরা মেনে নিয়েছেন নিয়েছেন যে, ইতিহাস চেতনা বাস্তবের সমস্ত দায়ভাগ ও
দায়িত্ব মেনে নিয়ে কঠিন ধৈর্য ও সংকল্পে,
সাংগঠনিক
শৃঙ্খলার বিন্যাসে, পরিণত
যুক্তিবোধের বিশ্লেষণে ইতিহাসের চেনাজানা প্রশস্ত রাজপথ ধরে এগিয়ে যাবার চেষ্টা
করে, তা ঋত্বিকের ছিল না” । (নরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত-‘ ঋত্বিক ঘটকের শেষ ছবি ‘যক্ত-তক্ক-গপ্পো’/সত্যজিৎ চৌধুরী
সম্পাদিত ‘চলচ্চিত্র চর্চা’) । তাই ঋত্বিক হাহাকার করেন “আমার অতীত আমাকে কে আনিয়া দিবে” ? বলেন “তাহার অনেকটাই
হয়তো ভুল, আমার মন গড়া । কিন্তু মন
গড়িয়াই তো আমার শিল্প । ফোটোগ্রাফির সত্য তো আমার ঠিকাদারির মধ্যে পড়ে না” । (সূত্র- সরমা ঘটকের ‘ঋত্বিক’)
১৯৬৩ সালে ভারতের পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে
অধ্যাপক হিসেবে দু’বছর কাজ করেছেন।
এরপর একই প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন আরও ৩ মাস। কিন্তু সেখানেও তাঁকে
আটকে রাখা যায়নি । ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই চাকুরী । তবুও তিনি মনে করতেন পুণে ফিল্ম
ইনস্টিটিউটের তাঁর শিক্ষকতার দিনগুলিই তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় । ঋত্বিক তার
এই শিক্ষকতা জীবনকে চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের উপরেই স্থান দিয়েছেন। বলেছেন “আমি মনে করি, আমার জীবনে যে সামান্য কয়েকটি ছবি করেছি সেগুলো
যদি পাল্লার একদিকে রাখা হয়, আর মাস্টারি যদি
আরেক দিকে রাখা হয় তবে মাস্টারিটাই ওজনে অনেক বেশি হবে। কারণ কাশ্মীর থেকে কেরালা, মাদ্রাজ থেকে আসাম পর্যন্ত সর্বত্র আমার
ছাত্র-ছাত্রীরা আজকে ছড়িয়ে গেছে”।
‘সুবর্ণ রেখা’র পর তাঁর কাছে কোন ছবির কাজ ছিল না। কোন
প্রযোজক এগিয়ে আসেনি । ব্যর্থতা আর হতাশা ভোলার অনুষঙ্গ হল লাগাম ছাড়া সুরাসক্তি ।
দেহে বাসা বাঁধল মারণ রোগ । মানসিক হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিল কিছু কাল ।
১৯৭৬এর ৬ই ডিসেম্বর মাত্র ৫১ বছর বয়সে
মৃত্যু হয় ঋত্বিক কুমারের ।
মৃণাল সেন – সেলুলয়েডে
প্রতিবাদী যৌবনের রূপকার
স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল আবহে কেটেছে
তাঁর শৈশব ও কৈশোর । জন্ম ১৯২৩ সনের ১৪ই মে,
ফরিদপুরে
। পিতা ছিলেন খ্যাতিমান উকিল বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আদালতে আইনী লরাই
চালাতেন । সেইসূত্রে ফরিদপুরে তাঁদের বাড়িতে বিপিন পাল, পূর্ণদাস প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের
যাতায়াত লেগে থাকতো, সুভাসচন্দ্র
বসুও আসতেন । স্কুল শিক্ষা শেষ করে আইএসসি
পড়লেন ফরিদপুরে । তারপর বিএসসি পড়ার জন্য চলে এলেন পাকাপাকিভাবে কলকাতায় । স্কটিশ
চার্চ কলেজে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়াশোনা, মেসে থাকা । মৃণাল সেনের আত্মকথন থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেবো, যা থেকে তাঁর মানস গঠনের স্পষ্ট ইঙ্গিত
পাওয়া যাবে । লিখছেন “মেসে ডাল ভাত, কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন । ইউনিয়ন নিয়ে মেতে
উঠলাম এস এফ আই । পোলিটিকাল লীডাররা আসতেন । বক্তৃতা দিতেন, ক্লাস করাতেন ...। পদার্থ বিদ্যার পাশে
কবিতা, কবিতার পাশে রাজনীতি, বোঝা যাচ্ছিল ‘প্রিয়,
ফুল
খেলবার দিন নয় অদ্য’ । কমিউনিষ্ট
পার্টি ছাড়া কিছু জানি না, আমার মাথার ওপর
উত্তর কোলকাতার আকাশও লাল হয়ে উঠছে,
ছোট
ছোট গোপন মিটিং মানুষের মুক্তি দেখছে,
তবু
জানি, কালের গলিত গর্ভ থেকে
বিপ্লবের ধাত্রী / যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে / তবু জানি, জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে
ভষ্ম হবে / আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে / ততদিন / ততদিন নারী ধর্ষণের ইতিহাস /
পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া / অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মত / ততদিন গর্ভের
ঘুমন্ত তপোবনে / বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার ।
১৯৪১এ একবার মেশ থেকে গ্রেপ্তার হলাম । তখন
কমিউনিষ্ট পার্টি বে-আইনি । বোধহয় ৭দিন ছিলাম লালবাজারে” ।
(‘ছবি করার আগের
দিনগুলি’ – মৃণাল সেন /
প্রলয় সূর সম্পাদিত মৃনাল সেন গ্রন্থ)
দু একটা টিউশানি, পত্রপত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে সামান্য কিছূ
আয় মাঝে মধ্যে আর ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে বইএর মধ্যে ডুবে থাকা । ১৯৪৬এ অনুবাদ
করলেন বিখ্যাত চেক নাট্যকার ও সমাজবিজ্ঞানী ক্যারল চাপেকের ‘দ্য চিট’ । ঐ বছরেই সিনেমা
বিষয়ক প্রথম লেখা ‘সিনেমা এন্ড দি
পিপল’ । ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে জড়িয়ে থেকে বিদেশের
ধ্রুপদি ছবি দেহা সমমনাদের সঙ্গে আলোচনা আর কালিঘাট দমকলের কাছে প্যারাডাইস কাফের
চায়ের টেবিলে আড্ডা । সেই আড্ডায় থাকতেন ঋত্বিক ঘটক, বংশী চন্দ্রগুপ্ত,
হৃষিকেশ
মুখার্জী, রাজেন তরফদার, তাপস সেন, সলিল চৌধুরীরা । মৃণালের স্মৃতিচারণে”আমাদের দিনরাত্তির এই আড্ডায় কি ছিল না, লেনিন,
স্টালিন,গণসঙ্গীত, চ্যাপলিন,
আইজেনস্টাইন, রাজশেখর বসু, কমিউনিস্ট পার্টি,
পাবলো
নেরুদা, পুদফকিন, ফিল্ম সোসাইটি, লাল পতাকা, সমর সেন, ধর্মঘট, ডি-সিকা, রোজেলিনি,
পিকাসো, নিও রিয়ালিজম, নবজীবনের গান,
ফেড
ইন আর ফেড আউট” (‘ছবি করার আগের
দিনগুলি’ – মৃণাল সেন /
প্রলয় সূর সম্পাদিত মৃনাল সেন গ্রন্থ) । ১৯৫০এ মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভের চাকরি
নিয়ে চলে গেলেন কানপুর । ছমাস কানপুর আর
ছমাস কলকাতায় ওষুধ বিক্রির কাজ করে আবার বেকার । দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই আর ভেতরে
ভেতরে সিনেমা নির্মাণ করার জন্য ছটপটানি ।
ইতিমধ্যে বন্ধু বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে
চলচ্চিত্র স্টুডিওতে যাতায়াত করছেন,
কলকাতায়
ফরাসি চিত্রপরিচালক জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য রিভার’ সুটিংএর খুঁটিনাটি টিনাটি, অন্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন, দুটি ছবিতে সহকারি পরিচালকের কাজ করে
চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করলেন । এই সময় সে কালের যশশ্বী অভিনেত্রী
তাঁর প্রযোজিত ছবির পরিচালনার জন্য আহ্বান জানালেন মৃণালকে । নির্মিত হল তাঁর
প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাতভোর’ ১৯৫৫তে । মৃণাল সেন নিজে তাঁর এই প্রথম
সিনেমাটিকে নিজের চলচ্চিত্র কেরিয়ারে ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না। বলেছিলেন “ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি, পৃথিবী কাঁপানো ছবি, আর আমার ছবি আমাকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে” । দ্বিতীয় ছবির প্রযোজক পেলেন সনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়কে । মহাদেবী বর্মার কাহিনী নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘নীল আকাশের নীচে’, ১৯৫৯এ । এটিকেও মৃণাল সেন হিসাবের মধ্যে
রাখেন না । তাঁর চলচ্চিত্র কীর্তি সম্পর্কিত কোন লেখায় তিনি ‘নীল আকাশের নীচে’র উল্লেখ করেন না’ । সেই সময়ের চিন-ভারত মৈত্রী সম্পর্কে আগ্রহ, সংবেদনশীল কাহিনী এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের
নেপথ্য সঙ্গীতের কারণে ছবিটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল এবং অর্থকরি সাফল্য পেয়েছিল ।
ছবিটি নির্মাণে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং এটি কখনোই পরিচালকের ছবি হয়ে ওঠেনি
বলেই মনে করেছিলেন মৃণাল । তথাপি অস্বীকার করা যাবে না যে ‘নীল আকাশের নীচে’র অর্থকরি সাফল্যই তাঁকে চলচ্চিত্র নির্মাণ জগতে
টিকে থাকার ছাড়পত্র দিয়েছিল এবং তাঁর পরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘বাইশে শ্রাবণ’ নির্মাণ সহজ করে দিয়েছিল । বাইশে শ্রাবণ তাঁর তৃতীয় ছবি ।
তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে মৃণাল সেনের কাছ
থেকে আমরা পেয়েছি ২৭টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র, ১৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের এবং ৪টি তথ্যচিত্র । বাংলা ও হিন্দি
ছাড়া তেলেগু ও ওড়িয়া ভাষায় একটি করে ছবি করেছেন । মৃণাল সেনের ছবিতে বরাবর গুরুত্ব
পেয়েছে সমাজ বাস্তবতা । তাঁর ছবিতে সত্তর দশকের ঝোড়ো সময়ের কথা এসেছে, নকশাল আন্দোলন যেমন এসেছে, এসেছে
শ্রেণীদ্বন্দ্ব, এসেছে দরিদ্র
আদিবাসীদের কথাও। তাঁর কলকাতা নিয়ে মৃণালের তিনটি ছবি ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ ও পদাতিক’এ সত্তর দশকের ঝোড় সময়ের অস্থির যৌবনকে
ধরেছেন । মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন এক দিন প্রতিদিন ও খারিজ
ছবিদুটিতে ।
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন – ভারতীয় চলচ্চিত্রের
তিনটি পৃথক ঘরানা । সত্যজিৎ রায় বাস্তবের চলচ্চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেন সাহিত্যকে
আশ্রয় করে, ঋত্বিক ঘটকের
সিনেমায় দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ক্রোধ আর মৃণাল
সেনের সিনেমায় কঠোর বাস্তবের সঙ্গে যৌবনের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে নেওয়া
চিত্রভাষ্য, আর্থ-সামাজিক
পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানুষের সংকটময় রূপের বিশ্লেষণ । জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের সঙ্গে
সিনেমার আর্টের সমস্ত দিকগুলির সংমিশ্রণ মৃণাল সেনের সিনেমায়, ছবির গল্পের তলে আর এক স্তরের গল্প বলেছেন
যেন তাঁর সিনেমায় । শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি
বুঝতে চেয়েছেন নিজের মত করে আর ধরে রেখেছেন তাঁর সিনেমায় ।
ঋত্বিক ঘটক চলে গেছেন ১৯৭৬এ, সত্যজিৎ রায় ১৯৯২এ, ৯৪ বছরে পা দিয়ে মৃণাল সেন এখনও রয়েছেন
আমাদের মধ্যে । শেষ ছবি করেছেন ‘আমার ভুবন’ ২০০২এ । জীবন ও শিল্পের অবিরাম প্রবাহ বয়ে
চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে । সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মণালদের বিছান পথে পরবর্তী
প্রজন্মের গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব
দাসগুপ্ত, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীরা
এসেছেন, এসেছেন আরো অনেকে ।
বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁদের কাজ আমাদের টেনেছেও । তাঁদের কাজ নিয়ে বলার পরিসর এই
নিবন্ধ নয় । আমি শুধু বুঝতে চেয়েছি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সিনেমায় সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এই ত্রয়ীয় অবদানটুকু ।
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়